মানবসম্পদ উন্নয়নে আলাদা মন্ত্রণালয় দরকার

উন্নয়ন চিন্তা 
সৈয়দ এরশাদ আহমেদ : স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর আমরা কী পেলাম, কতটা অগ্রগতি হলো দেশের সার্বিক অর্থনীতি, ব্যবসা- বাণিজ্যের, কৃষি ও শিল্পের – সে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। সত্যি বলতে, অগ্রগতি অবশ্যই হয়েছে। তবে এর আনুপাতিক হার আরও বেশি হতে পারতো। স্বাধীনতার পরে আমরা অনেক সাফার করেছি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন ১৯৭৫ সালে। সেখানে আমরা অবশ্যই ভীষণরকম হোঁচট খেয়েছি । তার পর আমাদের দেশে সামরিক শাসন-শাসক ছিল, সামরিক-সমর্থিত সরকার ছিল। ফলে নানা কারণে আমরা যথেষ্ট বাধাগ্রস্ত হয়েছি । দেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন আমাদের হাতে ধ্বংসস্তুপ ছাড়া আর কিছুই ছিলনা। দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। এসব ব্যাপারে আমাদের বেশ কিছু সমস্যার মধ্যে কয়েকটা বছর গেছে। ৮০’র পর থেকে মোটামুটি আমাদের দেশে অর্থনৈতিক উন্নতি শুরু হয়। বিশেষ করে রেডিমেড গার্মেন্ট শিল্প যখন শুরু হয় তখন থেকে উন্নয়নটা আমরা বেশি মাত্রায় দেখলাম। সত্যি কথা বলতে গেলে, ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন আমাদের দেশে গার্মেন্ট শিল্প দিয়েই শুরু হয়েছে। আর যদি কৃষির কথা বলি, তাও ১৯৮০ সালের পর থেকেই শুরু হয়। তখন বিভিন্ন ধরনের টেকনোলজি আসে আমাদের কৃষিতে। উন্নয়ন ঘটে আমাদের কৃষিতেও । মোটামুটি তখন থেকেই আমরা অর্থনৈতিক উন্নতির একটা পর্যায়ে পৌঁছই ।

আমরা আসলে অনেক জায়গাতেই বাধাগ্রস্ত হচ্ছি। অনেক পলিসির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। আমাদের অনেক পলিসি আছে, অনেক রীতিনীতি আছে যেগুলো বেশ পুরোনো। এগুলো অবশ্যই যুগোপযোগী হওয়া দরকার। আমরা আরও বাঁধা পাই আমলাতান্ত্রিক জটিলতায়। আমাদের সরকার গণতান্ত্রিক সরকার। তারপরও সরকার ইচ্ছা করলেও অনেক কিছু করতে পারে না। কারণ আমাদের যে প্রক্রিয়া, সে প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে গিয়ে আমরা অনেক কিছু থেকেই পিছিয়ে যাচ্ছি।

আমাদের আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। আমলাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। কারণ এখানটাতে আমরা বেশ বাঁধাগ্রস্ত হই। এই বাঁধা পাওয়ার কারণেও কিন্তু আমাদের নীতিগুলো আমরা পাল্টাতে পারছিনা, আপডেট করতে পারছিনা। যদি নীতি-বাঁধা আমরা কাটিয়ে উঠতে পারতাম, ভালো হতো। আমরা যে সে বাঁধা কাটাইনি তা না, তবে তার গতিটা হয়তো আরও দ্রুততর হতে পারতো।
আমাদের একটা বড় সম্পদ ‘হিউম্যান রিসোসর্’। ‘ভিশন টোয়েন্টি টোয়েন্টি ওয়ান’ যদি আমরা বাস্তবায়ন করতে চাই তাহলে এখন থেকেই মানবসম্পদ উন্নয়নে নজর দিতে হবে। এই সম্পদটাকে যদি আমরা কাজে লাগাতে পারি, তাহলে অনেক কিছু করতে পারব।

আমাদের শিক্ষার মান এবং পদ্ধতি দুটোই পাল্টাতে হবে। যে ধরনের শিক্ষা আমরা দিচ্ছি সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা যুগোপযোগী শিক্ষা দিচ্ছি কি না, যেটা কাজে লাগিয়ে আমরা রিসোর্স বাড়াতে পারব – সেই দিকটা আমাদের দেখতে হবে। কারিগরি শিক্ষায় আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের প্রচুর কারিগর দরকার। শুধু কৃষি বা ইন্ডাস্ট্রিতে নয়, দৈনন্দিন কাজ করার জন্যও আমাদের কারিগর দরকার হয়। আমাদের প্লাম্বারের দরকার আছে, ইলেক্ট্রিশিয়ানের দরকার আছে । আমার মনে হয়, এই জায়গাগুলো আমরা ঠিকভাবে চর্চা করতে পারছিনা।

ভোকেশনাল শিক্ষাই আমাদের কর্মমুখী শিক্ষা। এ শিক্ষাটাই আমাদের দরকার। আমাদের দেশে হায়ার লেভেলের শিক্ষা দরকার আর সেটা হতে হবে কোয়ালিটি শিক্ষা। যেখান থেকে রিসার্চ হবে। আমাদের অনেকগুলো ইউনিভার্সিটি। সেখানে কিন্তু রিসার্চ হচ্ছেনা। রিসার্চ যদি হতো, এ থেকে যদি নতুন কিছু বেরিয়ে আসত, তাহলে আমাদের দেশের চিত্রই পাল্টে যেতো। এই খাতটাতে আমাদের বড় একটা গ্যাপ রয়ে গেছে। এদিকে নজর দেওয়া উচিত। আমাদের মানবসম্পদকে প্রকৃত সম্পদে রূপান্তর করতে হবে। এখন যদি চিন্তা করি, আমাদের দেশে এত এত মিনিস্ট্রি আছে, কিন্তু মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য কোন মন্ত্রণালয় নেই। কেন নাই? লেবার মিনিস্ট্রি আছে, তবে লেবার মিনিস্ট্রি অন্য জিনিস। যারা লেবার ল নিয়ে কাজ করে। কিভাবে কর্মচারীদের সুযোগ সুবিধা বাড়ানো যায়, তাদের পরিচর্যা নিয়ে তারা কাজ করে। লেবার রাইটস নিয়ে তারা কাজ করে। কিন্তু হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্টের জন্য একটা মিনিস্ট্রি আমাদের দরকার; মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রণালয় বা এমন কিছু একটা। সেটা কিন্তু এখন পর্যন্ত আমাদের হয়নি। এটা আমাদের খুব দরকার বলে আমি মনে করি।

দেশের স্বাধীনতা আমরা অর্জন করেছি নিজেদের স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য। আমরা অবশ্যই অনেকদূর এগিয়েছি। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। কিন্তু অনেক কিছুতেই আমাদের নির্ভরশীলতা রয়ে গেছে। এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসার জন্য যা যা করা দরকার তাই করতে হবে। আমার ব্যবসায়িক বন্ধু যারা আছেন বা আমাদের দেশের সাধারণ জনগণ যারা আছেন, সবাইকে আমি অনুরোধ জানাবো, আপনারা সবাই দেশের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে যে যেখানেই থাকুন, আপনার নিজস্ব কাজের ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করুন। আমাদের সরকারি কর্মচারীরা যদি তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন, আমাদের ব্যবসায়ীরা যদি ইথিক্যাল- ওয়েতে ব্যবসা পরিচালনা করেন, নিশ্চিতভাবে আমাদের দেশের উন্নতি হবে। আমরা এগিয়ে যেতে পারব এবং ‘ভিশন টোয়েন্টি টোয়েন্টি ওয়ান’ আমরা অর্জন করতে পারব।

সৈয়দ এরশাদ আহমেদ
সাবেক প্রেসিডেন্ট, আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশ (এ্যামচেম)
ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রি-এফআইসিসিআই