রংপুর বিভাগের অন-গ্রিড এলাকায় শতভাগ গ্রাম বিদ্যুতায়নের আওতায়

রংপুর বিভাগের অন-গ্রিড এলাকায় শতভাগ গ্রাম ইতোমধ্যেই বিদ্যুতায়নের আওতায় আসার ফলে পল্লী এলাকায় মানুষের জীবনযাত্রার মান, গ্রামীণ অর্থনীতি ও জীবনযাত্রায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে।
বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি)’র কর্মকর্তারা বাসস’কে জানান, গত বছরের ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে রংপুর বিভাগের অন-গ্রিড অঞ্চলে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার আওতায় ৫৫ টি উপজেলার ৫১৪টি ইউনিয়নের ৯ হাজার ২৮৯ টি গ্রামকে শতভাগ বিদ্যুৎ সরবরাহ নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়।
বিআরইবি’র রংপুর জোনাল অফিসের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এ বি মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘আমরা আগামী মার্চ মাসের মধ্যে অফ-গ্রিড এলাকার দ্বিতীয় দফায় নতুন করে নির্বাচিত ১১৮টি প্রত্যন্ত চরাঞ্চলীয় গ্রামকে শতভাগ বিদ্যুতায়নের আওতায় আনতে কাজ করছি।’
অফ-গ্রিড এলাকায় বিভিন্ন নদ-নদী দ্বারা মূল ভূ-খন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এই ১১৮ টি দূর্গম চরগ্রাম কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলায় অবস্থিত।
এসব চরগ্রাম বিদ্যুৎ সরবরাহের আওতায় আনার লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই মোট এক হাজার ১৮৪ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় সাড়ে তিনশ’ কিলোমিটার বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন নির্মিত হয়েছে। অবশিষ্ট বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন নির্মাণের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে।
প্রকেীশলী হোসেন বলেন, ‘মূল ভূ-খন্ডের অন-গ্রিড অঞ্চলের বিদ্যুৎ সরবরাহ নেটওয়ার্কের সাথে অফ-গ্রিড চরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্যে বিভিন্ন নদ-নদীর তলদেশে সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপনের প্রক্রিয়া এখন দ্রুত গতিতে চলছে।’
প্রক্রিয়াটি অচিরেই সম্পন্ন হলে অন-গ্রিড অঞ্চলের বিদ্যুৎ সরবরাহ নেটওয়ার্কের সাথে অফ-গ্রিড চরাঞ্চলের বিদ্যুৎ লাইনগুলিকে সংযুক্ত করা হবে। এতে করে দূর্গম চরাঞ্চলের সকল মানুষ নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের আওতায় আসবেন।
চরাঞ্চলের অবশিষ্ট গ্রামগুলোকে বিদ্যুৎ সরবরাহ নেটওয়ার্কের আওতায় এনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দশটি বিশেষ উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম ‘সকলের জন্য বিদ্যুৎ’ উদ্যোগটিকে মুজিব বর্ষে সম্পূর্ণরূপে সফল করার জন্য রংপুর জোনের বিআরইবি’র আটটি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি নিরলসভাবে কাজ করছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা ২০০৯ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিগত ১২ বছরে রংপুর জোনের আটটি জেলায় ৪ দশমিক ৩৪ লক্ষ কিলোমিটার নতুন বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন, ১৩৪ টি সাব-স্টেশন এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করেছি।’
একই সময়ে রংপুর বিভাগের পল্লী এলাকায় ২৭ লাখ ৮০ হাজার বিভিন্ন ধরনের বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে ২৬ লাখ ৫৭ হাজার সুবিধাভোগী পরিবারকে বিদ্যুৎ সরবরাহ নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়েছে।
এর আগে ১৯৭৮ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বিগত ৩০ বছরের সময়কালে, বিআরইবি রংপুর জোনে মাত্র ২৪ হাজার ৬১০ কিলোমিটার বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন, ৬০ টি সাব-স্টেশন এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন।
উক্ত ৩০ বছর সময়কালে বিআরইবি রংপুর জোনের পল্লী অঞ্চলে ৬ লাখ ২৩ হাজার আবাসিক, শিল্প ও অন্যান্য বিভাগের বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছিল।
প্রকৌশলী হোসেন বলেন, ‘বিআরইবি’র রংপুর জোনে বর্তমানে সংযোগের সক্ষমতা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়ে ৩৩ লাখ ২২ হাজার টিতে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যেই দেয়া বিদ্যুৎ সংযোগের মোট সংখ্যা ৩৩ লাখ ৩০ হাজার। রংপুর জোনে বর্তমানে অন-গ্রিড এবং অফ-গ্রিড উভয় অঞ্চলে মোট ৪২ লাখ ৯৬ হাজার পরিবার বসবাস করছেন।’
গ্রামীণ বিদ্যুতায়নের সুবিধা কাজে লাগিয়ে বর্তমানে বিআরইবি’র রংপুর জোনের উদ্যোক্তরা ৩ লাখ ৪৪ হাজার বিদ্যুৎচালিত কুটির শিল্প এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ, কৃষিভিত্তিক এবং ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং কৃষকরা গ্রামাঞ্চলে সেচ পাম্প পরিচালনা করে কৃষি ক্ষেত্রে ফসল উৎপাদন উত্তোরোত্তর বৃদ্ধি করছেন।
প্রকৌশলী হোসেন আরো বলেন, ‘করোনভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারীর প্রাদূর্ভাব সত্বেও বিদ্যুৎচালিত উদ্যোগ এবং শিল্পগুলির দ্রুত বিকাশ হওয়ায় বেকার তরুণ-তরুনীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির ফলে দারিদ্র্য বিমোচনের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলের অর্থনৈতিক ও গ্রামীণ জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হচ্ছে।’
এব্যাপারে বাসস-এর সঙ্গে আলাপকালে বিভাগীয় কমিশনার আবদুল ওয়াহাব ভূঁইয়া রংপুর বিভাগ জুড়ে বিগত ১২ বছরে অন-গ্রীড এলাকার শতভাগ গ্রামকে বিদ্যুৎ সরবরাহের আওতায় আনতে বিআরইবি কর্তৃক অর্জিত বিরাট সাফল্যের প্রশংসা করেন।
‘এ সাফল্যের ফলস্বরূপ, গ্রামীন এলাকায় কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে। পাশাপাশি, গ্রামীণ অর্থনীতির ব্যাপক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সূচককে উন্নতি সাধন এবং প্রতিটি গ্রামকে একটি শহরে পরিণত করার জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি হয়েছে।’
রংপুর সদর উপজেলার মাটিয়াপাড়া গ্রামের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা শুধা রঞ্জন বাসস’র সঙ্গে আলাপকালে জানান, গ্রামীন এলাকায় বিদ্যুতায়নের সুবিধা কাজে লাগিয়ে তিনি নয় বছর আগে ওয়েল্ডিং কাজ করার জন্য স্থানীয় চন্দনপাট বাজারে একটি ওয়েল্ডিং কারখানা স্থাপন করে তার জীবন পরিবর্তন করেছেন।
‘এখন, আমি প্রতিমাসে ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা উপার্জন করে পরিবারের সদস্যদের সমস্ত চাহিদা মিটিয়ে স্বচ্ছল জীবন যাপন করি,’ খুশি রঞ্জন বলেন।
একই গ্রামের আনোয়ারুল ইসলামও সাত বছর আগে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে ওয়েল্ডিং কাজের জন্য চন্দনপাট বাজারে একটি কারখানা স্থাপন করেন।
তিনি বলেন, ‘এমনকি বর্তমানে কোভিড-১৯ মহামারী কালে আমি করখানার মাসিক বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করার পরেও প্রতিমাসে মাসে গড়ে প্রায় ২০ হাজার টাকা উপার্জন করি। পরিবারের সকল সদস্যদেরকে ভাল ও স্বচ্ছল জীবনযাপন করছি।’

সূত্র – বাসস