রমজান মাসের আগ থেকেই জোয়াগ গ্রামের মানুষের মধ্যে কর্মচাঞ্চল্যতা বেড়ে যায়

রমজান এলেই জোয়াগ গ্রামের মানুষের মধ্যে কর্মচাঞ্চল্যতা বেড়ে যায়। তখন একে অপরের সাথে কথা বলারও সময় থাকে না কারো। যার যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন সবাই। এ দৃশ্য রমজান মাস শুরুর তিন মাস আগ থেকে শুরু হয়ে পুরো রমজান মাস জুড়ে দেখা যায় কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার প্রত্যান্ত গ্রাম জোয়াগের প্রতিটি ঘরে ঘরে। এ গ্রামের সকল নারী পুরুষ এমনকি স্কুলে পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীরা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েন পোশাক তৈরীতে। সারা গ্রামে দেখা যায়, প্রতিটি বাড়ির আঙিনা ও অলিগলিত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে চুমকির কাজ করা বিভিন্ন রকমের ডিজাইনের তৈরী কাপড়। এ গ্রামের নারী-পুরুষ শিশুসহ সব বয়সের মানুষেই কাপড়ে চুমকির কাজ করা বিভিন্ন রকমের ডিজাইনের পোষক তৈরী করতে নিয়োজিত রেখেছেন নিজেকে। গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রীর পাশাপাশি তাদের সন্তানেরাও পিছিয়ে নেই। প্রত্যেকে নিজ নিজ কাজের ফাঁকে সময় অনুযায়ী কাপড়ে চুমকির কাজ করা যাচ্ছেন। তবে রমজানের ঈদকে সামনে রেখেই এখন জোয়াগ গ্রামের অধিকাংশ পরিবার এভাবে ব্যস্ত সময় কাটছে বিভিন্ন রকমের ডিজাইন তৈরীতে। এখান থেকেই বিভিন্ন ডিজাইনের তৈরী পোশাক চলে যায় ঢাকা সিটিসহ দেশের বিভিন্ন বড় বড় আলিশান মার্কেট গুলোতে। ঈদকে সামনে রেখে জোয়াগ গ্রামে যেসব পোশাক তৈরী হচ্ছে তা হলো থ্রী পিস, শাড়ি, লেহাঙ্গাসহ বিভিন্ন নিত্যনতুন ডিজাইনের জামা কাপড়।

সম্প্রতি জোয়াগ গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, নারী পুরুষ সবাই যার কাজ নিয়েই যেন ব্যস্ত। কাজের ফাঁকে ফাঁকে কথা হয় ওই গ্রামের কারখানার মালিক জুয়েল, মনির, ইয়াছিন, ইউসুফের সঙ্গে। তারা জানান, এ গ্রামের মানুষেরা ১২ মাসই চুমকির কাজ করা পোশাক তৈরী করে। তবে রমজানের ঈদকে কেন্দ্র করেই তিন মাস আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় তাদের কাজের কর্মচাঞ্চল্যতা। এ সময়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিত্য নতুন ডিজাইনের চুমকির পোশাক তৈরীতে। এখন সবাইর একটি লক্ষ্য থাকে ঈদের বাজার শেষ হবার আগেই দোকানীদের হাতে মাল তুলে দিতে হবে। সে কথা মাথায় রেখেই তারা কাজ করে যাচ্ছেন। তারা জানান, ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার বড় বড় দোকানীরা জোয়াগের বুটিক কারখানার মালিকদের সাথে কথা বলে তাদেরকে এ কাজের অর্ডার দেওয়া হয়। দোকানীরা কাপড়গুলো পিস করে সাথে ডিজাইনের ফটোকপি বুটিক মালিকদেরকে দিয়ে থাকে। তারা ডিজাইন অনুযায়ী কাপড়ে কাজ করে ঢাকায় নিয়ে মালগুলো দোকানে দিয়ে আবার নতুন নতুন মালের অর্ডার নিয়ে আসে। জোয়াগ গ্রামের বুটিক শিল্পের কারিগর গোলাম কিবরিয়া, কাউসার, ওয়াসীম, সুমন, তারা প্রত্যেকেই জানান, সকাল ৮ থেকে রাত ১২ পর্যন্ত কাজ করেন এবং কাজের ফাঁকে দুবার বিশ্রাম নেন তারা। মাস শেষে পারিশ্রমিক পান প্রত্যেকেই চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা করে। তবে রোজার মাস এলেই তাদের পারিশ্রমিক বেড়ে যায়। তখন প্রত্যেক কারিগর পান ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। এ চুমকির কাজ করে যে টাকা পাচ্ছে সে টাকা পেয়ে কারিগররা সবাই খুশি। তারা বলেন, আমরা আমাদের নিজ গ্রামের বসে পরিশ্রম করে টাকা কামাই করছি এটা তো বড়ই আনন্দের। তবে তাদের চুমকির পোশাক তৈরীর কাজ শবেকদর রাত পর্যন্ত চলবে। যেভাবে শুরুঃ ১৯৯১ সালে জোয়াগ গ্রামের মবিন মিয়া নামের এক ব্যক্তি ঢাকার গাউছিয়া মার্কেটে কাপড়ের দোকান দেন। সেখানে মবিন মিয়া এ কাজ শেখেন। পরবর্তীতে মবিন মিয়া জোয়াগের সোলেমান নামক এক ব্যক্তিকে এ কাজ শিখিয়ে তাকে গ্রামে পাঠিয়ে দেন। সোলেমান গ্রামে এসে বুটিকের কাজ শুরু করেন এবং কাজ শেষে কাপড় গুলো সোলেমান তার মালিক মমিনের ঢাকার দোকানে পাঠাতো বিক্রির জন্য। আর সোলেমানকে দেওয়া হতো মাস শেষে পারিশ্রমিকের টাকা।

বুটিক শিল্পের প্রসারঃ সোলেমান যখন তার নিজ গ্রামে বুটিকের কাজ ১৯৯১ সালে শুরু করলো। তখন গাঁয়ের মানুষ বুটিকের কাজের চাহিদা দেখে আস্তে আস্তে এ কাজের প্রতি আগ্রহ হলো। তখন গাঁয়ের মানুষ সোলেমানের কাছে কাজ শিখতে শুরু করে। এবং তারা কাজ শিখে এক এক করে পৃথক পৃথক ভাবে কারখানা করার কারণে এখন পুরো গ্রামে ৭’শ পরিবারের বেশি এ বুটিক শিল্পের সাথে জড়িত হওয়ার কারণে দিন দিন এ শিল্পের প্রসার ঘটছে এ গ্রামে। কীভাবে তৈরী করা হয়ঃ ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার বড় বড় দোকানীরা জোয়াগের বুটিক মালিকদের সাথে কথা বলে তাদেরকে এ কাজের ওয়াডার দেওয়া হয়। দোকানীরা কাপড়গুলো পিস করে সাথে ডিজাইনের ফটোকপি বুটিক মালিকদেরকে দিয়ে থাকে। তারা ডিজাইন অনুযায়ী কাপড়ে কাজ করে থাকে। তৈরী করতে কি কি লাগেঃ তৈরী করা প্রথমত একটি চার কোণো কাঠের ফ্রেম। ফ্রেমে কাপড়টি আটিয়ে কাজ শুরু করতে হয়। কাপড়ে ডিজাইন অনুযায়ী কারিগররা কাজ করে থাকে। কাজ করতে যে সব জিনিষের প্রয়োজন হয় তা হল-পুঁতি, ভলিয়ম, পাথর. আইকা, চুমকি, জরি, দপকা, সুঁই, সুতা, নিমজরি, সিলকী, ডলার, গ্লাস, প্লষ্টিক ফুল, হাফ পাইভ, ফুল ফাইভ, গমপুঁতি, তারা চুমকি, দেবদাস চুমকি ছাড়াও ডিজাইন অনুযায়ী আরো অনেক মালামালের প্রয়োজন হয়। একটি ভাল ডিজাইনের কাজ তৈরী করতে একজন কারিগর সময় নিচ্ছে ২ থেকে ৩ দিন সময়। মালামাল কোথায় পাওয়া যায়ঃ ডিজাইনের যত মালামাল প্রয়োজন হচ্ছে সে সব মালামাল ঢাকার গাউছিয়া মার্কেট, নূর ম্যানসন, ইসমাইল ম্যানসন থেকে পাইকারী ও খুচরা পাওয়া যায়।

মালামালের দামঃ মালামাল কিনতে বিভিন্ন ধরনের কোয়টির মাল রয়েছে তার মধ্যে চুমকি প্রতি প্যাকেট ১০০ গ্রাম এর দাম ৮০ টাকা, পুঁতি প্রতি প্যাকেট ৫০০ গ্রামের দামও ৮০ টাকা, দপকা প্রতি কেজি ১২০০ টাকা, সুঁতা প্রতি পাউন্ড এর দাম ৪০০ টাকা, জরি প্রতি প্যাকেট ১০০ গ্রাম এর দাম ৬০ টাকা, হাফ পাইফ প্রতি প্যাকেট ১০০ গ্রাম এর দাম ১১০ টাকা, পাথর প্রতি প্যাকেট ১০০ গ্রাম এর দাম ৬০০ টাকা। কারিগরদের কথাঃ গোলাম কিবরিয়া, ওমর ফারুক, রোমান, কাউসার, ওয়াসীম, সুমন, আনোয়ার তারা প্রত্যেকেই জোয়াগ গ্রামের বিভিন্ন কারখানার কারিগর তারা জানান সকাল ৮ থেকে রাত ১২ পর্যন্ত কাজ করেন এবং কাজের ফাঁকে দুবার বিশ্রাম নেন তারা। তারা প্রত্যেকেই মাস শেষে পান ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা । তারপরেও এ টাকা পেয়ে কারিগররা খুশি। তারা বলেন ,আমরা আমাদের নিজ গ্রামে বসে পরিশ্রম করে টাকা কামাই করছি এটা তো বড়ই আনন্দের। মালিকদের কথা: জোয়াগের ৩টি কারখানার মালিক জুয়েলসহ অন্যান্য কারখানার মালিক মনির, ইয়াছিন, ইউসুফ জানান ,কারিগরদের দিয়ে কাজ করিয়ে মালমাল নিয়ে ঢাকায় মালিকদের কাছে গেলে তারা কাজ দেখে টাকা দেন। স্থানীয় চেয়ারম্যানের কথা: জোয়াগ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান জানান, এ ইউনিয়নের প্রায় সকল মানুষ বুটিক শিল্পের সাথে জড়িত থাকার কারণে এ ইউনিয়নে চুরি-ডাকাতিসহ অন্যান্য সামাজ বিরোধী কোন কাজ হয় না । সবাই যার যার কাজ নিয়েই ব্যস্ত। হতে পারে দৃষ্টান্ত: কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার জোয়াগ গ্রামের মানুষ দৃষ্টান্ত হতে পারে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের কাছে। শুধু জানা প্রয়োজন এগুলো কীভাবে তৈরী করা হয়। খবর-বাসস

আজকের বাজার/ আখনূর রহমান