বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনী বছরে আবারও সহিংস জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটতে পারে বলে সতর্ক করেছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ-আইসিজি। বুধবার আইসিজি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই সতর্ক বার্তা এসেছে।
গবেষণার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংঘাত ও তার নিরসনে করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়া এই আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক মেরুকরণে যে সংকট তৈরি হয়েছে, ইসলামপন্থি জঙ্গিদের তার সুযোগ নেওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
‘কাউন্টারিং জিহাদিস্ট মিলিটান্সি ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের এই গবেষণায় বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সহিংসতার বিরতি ‘সাময়িক’ হিসেবে প্রতীয়মাণ হতে পারে।
তাদের মতে, জামায়াতুল মজাহিদিন বাংলাদেশ বা জেএমবি এবং আনসার আল ইসলামই এখন বাংলাদেশে জঙ্গিবাদী কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করছে।
২০০৪ থেকে ২০০৮ সালে বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার কথা উল্লেখ করে এতে বলা হয়, “পরবর্তীতে, বিশেষত ২০১৪ সালের জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের পর তীব্র রাজনৈতিক বিভেদ নতুনভাবে জিহাদি কার্যক্রমের পথ খুলে দেয়।”
দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড আবার ২০১৪-২০১৫ সালের রাজনৈতিক সংঘাত ফিরিয়ে আনতে পারে বলে মনে করছে আইসিজি।
তাদের মতে, বাংলাদেশ সরকার সন্ত্রাস দমন কৌশলকে গুরুত্ব না দিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম এবং অহরহ রাজনৈতিক প্রতিদ্ব্ন্দ্বীদের ওপর চড়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যেখানে জঙ্গি তৎপরতা এবং আল-কায়েদা ও আইএসের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতার ওপর নজর দেওয়া উচিত।
জেএমবির একটি অংশের সঙ্গে আইএসের যোগাযোগ রয়েছে বলে ধারণা আইসিজির। আর আনসার আল-ইসলামকে আল-কায়েদার দক্ষিণ এশিয়া শাখা সংশ্লিষ্ট হিসেবে বর্ণনা করেছে তারা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক জঙ্গিবাদের ইতিহাস নব্বই দশকের শেষ দিকের, যা শুরু করে আফগান যুদ্ধ ফেরতরা।
জঙ্গিদের প্রথম দফা তৎপরতার সবচেয়ে বড় প্রকাশ ঘটে ২০০৫ সালে একযোগে ৬৩ জেলায় বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে।
“এরপরে সরকার জেএমবি নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু তারপরেও জঙ্গি গোষ্ঠীটি আবারও নতুন রূপে সংগঠিত হয়। অপর গোষ্ঠী আনসার-আল ইসলামের উত্থান ঘটে, এদিকে জেএমবির আরেকটি শাখার আত্মপ্রকাশ ঘটে, যাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ‘নিও জামায়াতুল মুজাহিদ’ বলেছে, তারা নিজেদের ইসলামিক স্টেট-বাংলাদেশ বলে পরিচয় দিয়েছে এবং সিরিয়া ও ইরাকে যোদ্ধা পাঠিয়েছে।”
দ্বিতীয় দফা জঙ্গিবাদের উত্থানের পেছনে রাজনৈতিক বিরোধ কাজ করেছে বলে মনে করে আইসিজি। তাদের ভাষ্য, ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে ‘ইসলামের ওপর আঘাত’ হিসেবে বিবেচনা করেছে আনসার-আল ইসলাম এবং সেখান থেকে তারা ব্লগার ও মুক্তমনাদের ওপর হামলা করেছে, যারা যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়েছিল।
আইসিজির মতে, জেএমবির কাছে ‘শত্রুর’ তালিকা অনেক বড়। ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বিরোধিতার পাশাপাশি তাদের মতো করে ইসলাম পালনে অনাগ্রহীদেরই তারা লক্ষ্যবস্তু করে।
আহমাদিয়া মসজিদ, মাজার, বৌদ্ধ ও হিন্দু মন্দির ও শিয়াদের তাজিয়া মিছিলসহ সংখ্যালঘু, ধর্মীয় স্থাপনা ও অনুষ্ঠানের হামলার যে সব ঘটনায় আইএসের নামে দায় স্বীকারের বার্তা এসেছে, সেগুলো এই জঙ্গি গোষ্ঠীর কাজ বলে পুলিশের ভাষ্য।
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে গুলশানের হলি আর্টিজান ক্যাফেতে হামলা চালিয়ে ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে হত্যার ঘটনা উল্লেখ করে আইসিজি বলছে, গ্রামের মাদ্রাসা ছাত্র এবং শহরের অভিজাত পরিবারের তরুণদের ওই হামলা বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীর মধ্যে তেমন সমন্বয় না থাকার চিত্রকে প্রকাশ করেছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জঙ্গিবাদের হুমকিকে রাজনৈতিক পুঁজি করছে অভিযোগ করে সংগঠনটি বলছে, “জঙ্গিবাদীদের নতুনদের দলে ভেড়ানো এবং তাদের হামলার ঝুঁকি নির্মূলের কাজকে গুরুত্ব না দিয়ে তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করছে।”
জঙ্গিবাদ দমনের বিষয়ে বৃহত্তর পরিসরে সামাজিক ও রাজনৈতিক মতৈক্য তৈরি এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক দমন-পীড়ন বন্ধ করার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে জবাবদিহি নিশ্চিতে পদক্ষেপ গ্রহণে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে আইসিজি।
এমআর/ ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮