রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে যেসব চুক্তি স্বাক্ষর করা দরকার ছিল তা সবই ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। গত ১৬ জানুয়ারি সর্বশেষ মাঠপর্যায়ে ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর আগে গত ১৯ ডিসেম্বর যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়। এছাড়াও গত ২৩ নভেম্বর প্রথম বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে একটি অ্যারেঞ্জমেন্ট স্বাক্ষরিত হয়।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কাগজ কলমে দালিলিক প্রমাণ ও আইনগত সব প্রক্রিয়া শেষ হলেও নিজ দেশে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে এখনও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সব চুক্তিগুলো স্বাক্ষরিত হওয়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে একটা বড় অগ্রগতি। কিন্তু সঠিকভাবে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে এখনও বেশ কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো সঠিকভাবে মোকাবেলা করতে না পারলে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তিতে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর ও চলতি বছরের ২৫ আগস্টের পরে যে সমস্ত রোহিঙ্গা জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে ওইসব রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়া হবে।
এদিকে, চুক্তিতে বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দেওয়ার ফলে স্বদেশে ফেরাটা অনিশ্চিত হয়ে গেছে নতুন করে আসা প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গার। এর আগে বিভিন্ন সময়ে পালিয়ে আসা আরো ৩ লাখের অধিক রোহিঙ্গার বিষয়ে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে সম্পাদিত চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদেরকে কবে, কখন, কিভাবে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাবনা আসেনি।
সর্বশেষ মাঠপর্যায়ে ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট স্বাক্ষরিত হওয়ার পর মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুফিউর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব ছিল মিয়ানমার যেন প্রতি সপ্তাহে ১৫ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়৷ কিন্তু মিয়ানমার বলেছে, এজন্য তাদের প্রস্তুতি নেই৷ তারা সপ্তাহে ১৫শ' করে রোহিঙ্গা ফেরত নিতে সম্মত হয়েছে৷ তিন মাস পরে রিভিউ করে এই সংখ্যা বাড়বে৷ বাড়ানো হবে এমনভাবে যাতে তারা দুই বছরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে পারে৷’
তিনি বলেন, ২২ জানুয়ারি থেকে প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার যে কথা সংবাদমাধ্যম বলছে তাতে বোঝার ভুল আছে৷ ২৩ নভেম্বরের চুক্তিতে বলা হয়েছে দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে৷ আমরা আগেই ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট চুক্তির মাধ্যমে তা শুরু করলাম৷ ঠিক কবে থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়া শুরু হবে তা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব হচ্ছে না৷
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত অনুপ কুমার চাকমা বলেন, চুক্তিগুলো স্বাক্ষর হয়েছে এটা অনেক বড় পজেটিভ অগ্রগতি। তবে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে এখনও বেশ কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়াটা হলো এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এর পরের চ্যালেঞ্জ হলো তাদের প্রত্যাবার্তন। বাংলাদেশ পাঁচটা ক্যাম্পে থেকে রোহিঙ্গাদের পাঠাবে। মিয়ানমার দুইটি ক্যাম্প থেকে সেটা গ্রহণ করবে। কিভাবে রাখবে, কোথায় রাখবে এই পুরো ব্যবস্থাটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এরপর যে ব্যবস্থায় রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে এভাবে তারা দেশে ফিরে যেতে আগ্রহী কি না সেটা দেখতে হবে। আবার তাদেরকে দেশে ফেরত পাঠাতে আগ্রহী করে তোলাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
অনুপ কুমার চাকমা আরো বলেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে যাওয়ার পরে নাগরিকত্ব পাওয়াটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য তাদেরকে প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে হবে। তারা আবেদন করবে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ইস্যুটা যদি সমাধান না হয় তাহলে এই সমস্যা থেকেই যাবে।
তিনি বলেন, মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখাতে হবে। তারা ২০১৬ সালের অক্টোবরের পরে যারা এসেছে তাদের ফিরিয়ে নেবে এবং পরে অন্যদের বিষয়টি বিবেচনা করবে। সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন চলে আসে, যদি ফেরতই নেবে, তবে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করলো কেন?
কূটনীতিক ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, কাগজ কলমের কাজ যা হয়েছে সব ঠিক আছে। একটা বড় ধরনের অগ্রগতি। যতই আন্তর্জাতিক চাপ থাক মিয়ানমারকে বাদ দিয়ে কিন্তু রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব না। তাদেরকে একটা ফ্রেমে আনা গেছে এটা বড় একটা কাজ হয়েছে।
শমসের মবিন অরো বলেন, যারা মূলত আক্রান্ত হয়েছে তারা কতটুকু আশ্বস্থ হতে পারছে যে, তারা সেখানে নিরাপদে ফিরে যেতে পারবে, নিরাপদে বসবাস করতে পারবে। এটা নিশ্চিত করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তারা কী সেখানে গিয়ে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারবে একটাই এখন বড় প্রশ্ন। আর এটার উত্তর মিয়ানমারকেই দিতে হবে।
তিনি বলেন, এখানে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, মিয়ানমারকে কীভাবে আমরা বিশ্বাস করবো, যখন তারা ধারাবাহিকভাবে আমাদের বিশ্বাসভঙ্গ করছে। ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত চুক্তির মূল একটি বিবেচ্য বিষয় ছিল, রোহিঙ্গারা যাতে আর পালিয়ে না আসে সে জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেবে মিয়ানমার। মিয়ানমার এখনও তাদের ভুলই শিকার করছে না। আর যারা অপরাধ করেছে তাদের কি শাস্তি হবে সেটাও তো কিছুই বলছে না তাহলে তাদেরকে কিভাবে বিশ্বাস করবো।
মিয়ানমার যে কিছু দিন পরে আবারো রোহিঙ্গাদের নির্যাতন করে তাড়িয়ে দেবে না, আবার যে সেদেশের সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করবে না তার কি নিশ্চয়তা আছে? এমন প্রশ্ন রাখেন এই কূটনীতিক।
সুত্র: পরিবর্তন.কম
আজকের বাজার: সালি / ১৮ জানুয়ারি ২০১৮