মায়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা এবং সেখান থেকে তাদের বিতাড়িত করার যে প্রক্রিয়া চলছে,তা থেকে উত্তরণের জন্য মুসলিম বিশ্বের সামনে ছয়টি প্রস্তাব পেশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
২০ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ওআইসি কনট্যাক্ট গ্রুপের বৈঠকে শেখ হাসিনা প্রস্তাবগুলো তুলে ধরেন।
রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধ এবং তাদের জাতীয়তা নিয়ে মায়ানমারের অপপ্রচার বন্ধ করাসহ ছয়টি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব মুসলিম দেশগুলোর নেতাদের সামনে তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
স্থানীয় সময় গতকাল ১৯ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার রাতে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ওআইসি কনট্যাক্ট গ্রুপের বৈঠকে শেখ হাসিনা এসব প্রস্তাব দেন।
প্রস্তাব ছয়টির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, রোহিঙ্গা নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য মায়ানমারের ভেতরে নিরাপদ এলাকা (সেইফ জোন) তৈরি করা। রোহিঙ্গাদের জাতীয়তা দিয়ে নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়া, এ জন্য মায়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করাসহ রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশকে সহায়তা দান।
তিনি বলেন, এটা এক অবর্ণনীয় মানবিক বিপর্যয়। আমি নিজে তাদের কাছে গেছি, তাদের মুখ থেকে, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের ভয়াবহ দুর্ভোগের বিবরণ শুনেছি। আমি বলব, আপনারা সবাই আসুন, এই শরণার্থীদের মুখ থেকে শুনে যান, মায়ানমারে কি রকম নির্মমতা চলছে।
এই অবস্থা নিরসনে ওআইসিভুক্ত দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহবান জানান শেখ হাসিনা।
রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে ফেরত পাঠানোর জন্য বাংলাদেশ কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে গেলেও মায়ানমার তাতে সাড়া দিচ্ছে না বলে মুসলিম দেশের নেতাদের জানান শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ছয়টি প্রস্তাব হলো:
১. রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সব ধরনের নিপীড়ন এই মুহূর্তে বন্ধ করতে হবে।
২. নিরপরাধ বেসামরিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য মায়ানমারের ভেতরে সেইফ জোন (নিরাপদ এলাকা) তৈরি করা যেতে পারে, যেখানে তাদের সুরক্ষা দেয়া হবে।
৩. বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বাস্তুচ্যুত সব রোহিঙ্গা যেন নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে মায়ানমারে তাদের বাড়িতে ফিরতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে কফি আনান কমিশনের পূর্ণাঙ্গ সুপারিশ অবিলম্বে নিঃশর্তভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
৫. রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ হিসেবে চিহ্নিত করার যে রাষ্ট্রীয় প্রোপাগান্ডা মায়ানমার চালাচ্ছে, তা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
৬. রোহিঙ্গারা মায়ানমারে না ফেরা পর্যন্ত তাদের জরুরি মানবিক সহায়তা দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে হবে ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম দেশগুলোকে।
মুসলিম বিশ্বের নেতাদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা এই ‘জাতিগত নির্মূল’ অভিযানের অবসান দেখতে চাই। আমাদের মুসলমান ভাইদের এই দুর্দশার অবসান চাই। এই সংকটের সূচনা হয়েছে মায়ানমারে এবং সেখানেই এর সমাধান হতে হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘মায়ানমারে এখন মুসলমান ভাই-বোনেরা জাতিগত নির্মূল অভিযানের মুখোমুখি হয়েছে। রাখাইন রাজ্যে মায়ানমার কর্তৃপক্ষের চালানো সামরিক অভিযান বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। এ ঘটনায় এবারই সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়ে দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়েছে। ইতোমধ্যে চার লাখের বেশি মানুষ মায়ানমার থেকে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। এই শরণার্থীদের ৬০ শতাংশই শিশু।’
রোহিঙ্গাদের দুঃখ-কষ্টের বর্ণনা দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এটা এক অবর্ণনীয় মানবিক বিপর্যয়। আমি নিজে তাদের কাছে গেছি, তাদের মুখ থেকে , বিশেষ করে নারী ও শিশুদের ভয়াবহ দুর্ভোগের বিবরণ শুনেছি। আমি বলব, আপনারা সবাই আসুন, এই শরণার্থীদের মুখ থেকে শুনে যান, মায়ানমারে কীরকম নির্মমতা চলছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘মায়ানমার পরিকল্পিত ও সংগঠিত উপায়ে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বের করে দিচ্ছে। প্রথমত তারা নিবন্ধিত জাতিগোষ্ঠীর তালিকা থেকে রোহিঙ্গাদের বাদ দিয়েছে। তারপর ১৯৮২ সালের আইনে তাদের নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকার করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশেই আইডিপি ক্যাম্পে পাঠিয়েছে তারা।’
রোহিঙ্গাদের চলমান সংকট নিরসনে মুসলিম দেশগুলোকে আরও বেশি তৎপর হওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে ওআইসিকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়ার আহবান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবিলায় ওআইসির সদস্যভুক্ত দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহবান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এ বিষয়ে ওআইসির যে কোনো উদ্যোগে অংশ নিতে বাংলাদেশ প্রস্তুত রয়েছে।
উল্লেখ, গত ২৫ আগস্ট পুলিশ পোস্ট ও একটি সেনা ক্যাম্পে হামলার পর দেশটির সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলমানদের গ্রামে গ্রামে নতুন করে দমন অভিযানে নামে।এর পর চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরনার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
আজকের বাজার : এলকে/এলকে ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭