চলমান রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে ও বাস্তুহারা রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনে নিরাপত্তা পরিষদে পাঁচ দফা সুপারিশ প্রস্তাব করেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।
গতকাল মঙ্গলবার নিউ ইয়র্কে নিরাপত্তা পরিষদের এক বৈঠকে মহাসচিবের পক্ষে এসব সুপারিশ উপস্থাপন করেন জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জেফ্রি ফেল্টম্যান। সূত্র: ইউএন নিউজ।
মায়ানমার পরিস্থিতির উপর গত ৬ নভেম্বর প্রেসিডেন্সিয়াল স্টেটমেন্ট গ্রহণের ৩০ দিনের মধ্যে এ সংক্রান্ত বিবৃতি দিতে জাতিসংঘ মহাসচিবকে অনুরোধ জানায় নিরাপত্তা পরিষদ।
সুপারিশগুলো হল- কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদনকে ভিত্তি ধরে শান্তিপূর্ণ ও স্থায়ীভাবে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা; বাস্তুচ্যুতদের মূল ভূমিতে বা পছন্দনীয় কাছাকাছি কোনো স্থানে প্রত্যাবাসন করা; জীবন ধারণের মৌলিক সব প্রয়োজন মেটাতে অবাধ চলাফেরার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা; প্রত্যাবাসনের যোগ্যতার ক্ষেত্রে উদার মানদণ্ড নির্ধারণ এবং সকল প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো।
জাপানের সভাপতিত্বে চলতি সভায় নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলোর বাইরে বাংলাদেশ ও মায়ানমার বক্তব্য দেয়। বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য দেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন।
গত ২৫ অগস্টের পর থেকে মায়ানমারে সহিংসতার মুখে রাখাইন থেকে ৬ লাখ ২৬ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। গত কয়েক দশকে আরও প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
মোমেন বলেন, এখনও প্রতিদিন গড়ে ১০০ থেকে ৪০০ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এতে প্রমাণ হয়, রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি।
গত ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ -মায়ানমারের মধ্যে সম্পাদিত সম্মতিপত্রের বিষয়ে তিনি বলেন, ওই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী শিগগিরই জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হবে এবং মিয়ানমারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব হবে।
‘কিন্তু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবিক দুর্দশার যে মূল কারণ, তা দূর করতে এ সংক্রান্ত বহুবিধ বিষয় ও অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো মায়ানমারকেই সমাধান করতে হবে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অব্যাহত সহাযোগিতা ও পর্যবেক্ষণ একান্তভাবে প্রয়োজন, আর তা করতে হবে অসহায় রোহিঙ্গাদের স্বার্থের কথা বিবেচনায় রেখেই’।
রাষ্ট্রদূত মোমেন তার বক্তব্যে মায়ানমারের বাস্তুচ্যুত অসহায় নাগরিকদের মানবিক সহায়তা দেওয়া, সহিংসতার নিরপেক্ষ এবং স্বাধীন তদন্ত ও বিচার, রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করা এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে একত্রে বসবাসের উপযোগী পরিবেশ তৈরির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলোর প্রতিনিধিদের পাশাপাশি অন্যদের মধ্যে বৈঠকে বক্তৃতা করেন ‘সংঘাতময় এলাকায় যৌন সহিংসতা বিষয়ক’ জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি প্রমীলা প্যাটেন।
সাম্প্রতিক সফরে বাংলাদেশের উদ্বাস্তু ক্যাম্পগুলোয় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের ওপর রাখাইনে যে ভয়াবহ যৌন সহিংসতা হয়েছে, নির্যাতিত নারী ও শিশুদের কাছ থেকে শোনা সেই বর্ণনা তিনি বৈঠকে তুলে ধরেন।
প্যাটেন বলেন, ‘যারা এখনও যৌন সহিংসতার ক্ষতচিহ্ন নিয়ে বেঁচে আছেন এবং যারা নিষ্ঠুরতম এই যৌন সহিংসতার দৃশ্য নিজ চোখে দেখেছেন, তাদের সবাই আমাকে বলেছেন, নারকীয়ভাবে মিয়ানমারের সেনা সদস্যরা ধর্ষণ, গণধর্ষণ এবং সেনাক্যাম্পে আটক রেখে দিনের পর দিন যৌনদাসত্বে বাধ্য করার মত জঘন্য কাজ করেছে।’
তিনি সহিংসতার শিকার এমন অনেক নারীর উদাহরণ দেন, যাদের কেউ কেউ টানা ৪৫ দিন সেনা ক্যাম্পে ধারাবাহিক যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
প্যাটেন জানান, অনেক মেয়েকে তার স্বামী অথবা বাবার সামনে নগ্ন করে ধর্ষণ করা হয়েছে। অনেক মায়ের সন্তানদের গ্রামের কূপে ডুবিয়ে মারা হয়েছে। শিশুকে কেড়ে নিয়ে শিশুর সামনে মাকে ধর্ষণ করা হয়েছে; এবং ধর্ষণ শেষে শিশুটিকে আগুনের নিক্ষেপ করার মতো ঘটনা ঘটেছে।
এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা জানিয়ে প্যাটেন দ্রুত এই সহিংসতার সমাধানে নিরাপত্তা পরিষদকে সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগের আহবান জানান।
আজকের বাজার:এলকে/১৩ ডিসেম্বর ২০১৭