লক্ষ্মীপুরে নারী-পুরুষদের পরিশ্রমী ও স্বাবলম্বী করে তুলছে ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্প

All-focus

মোহাম্মদ কবির হোসাইন লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ বাজার বড় জামে মসজিদের ইমাম। একই সঙ্গে তিনি নিজের বাড়িতে মৎস্য, হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশুর খামার গড়ে তুলেছেন। নিজের খামারে উৎপাদিত মাছ ও মাংসে পারিবারিক চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি তিনি বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি করে আয়ের নতুন উৎস সৃষ্টি করেছেন। ফলে তার পারিবারিক অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে প্রতিদিনই। জাতীয় উৎপাদন ও অর্থনীতিতেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এদিক থেকে নিঃসন্দেহে কবির হোসাইন একজন সফল ও স্বাবলম্বী ব্যক্তি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগ ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ অর্থাৎ ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পের পথ ধরেই তার এ সফলতা। কবির হোসাইন ২০১৪ সালে ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পের অধীনস্থ লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের ‘উত্তর চরভূতা গ্রাম উন্নয়ন সমিতি’র সদস্য হন। তখন তার বাড়ি থাকলেও খামার ছিল না। তিনি একাধিকবার চেষ্টা করেও যথাযথ প্রশিক্ষণ ও সহজলভ্য ঋণের অভাবে খামার করতে পারছিলেন না। পরে তিনি ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পের পথ ধরেই সফলতা খুঁজে পান। কবির হোসাইন মাসিক দুইশত টাকা করে সঞ্চয় জমার পাশাপাশি যথাযথ প্রশিক্ষণ ও সহজ শর্তে ঋণ গ্রহণ করে নিজের বাড়িতে গড়ে তোলেন খামার। তিনি ক্রমান্বয়ে ১০ হাজার, ২৫ হাজার ও ৫০ হাজার টাকা ঋণ নেন। বর্তমানে তার খামারে আলাদা দু’টি ঘরে ব্রয়লার ও কক মুরগির বাচ্চা লালন-পালন করা হয়। দু’টি পুকুরে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ হয়। খামারে তিনটি গরু রয়েছে। গরুর গোবরকে কেন্দ্র তৈরি একটি বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট থেকে উৎপাদিত গ্যাসে পূরণ হচ্ছে পারিবারিক জ্বালানি চাহিদা। এছাড়াও পরিকল্পিতভাবে বাড়ির আঙ্গিনায় নারিকেল, সুপারি, উন্নত জাতের আম, কাঁঠাল, জাম্বুরা, বরই, লেবু, আমড়া ও কমলার গাছ লাগিয়েছেন কবির হোসাইন। তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা খামারের কাজে তাকে সহযোগিতা করেন। খামারের আয় দিয়ে ভালোই চলছে তার সংসার।

কবির হোসাইনের মতো ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পের পথ ধরে সঞ্চয়ী ও স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার উত্তর জয়পুর ইউনিয়নের অনিমা রাণী দাস। তিনি ছিলেন একটি হতদরিদ্র পরিবারের গৃহবধূ। অভাব-অনটনে জর্জরিত ছিল তার সংসার। ২০১৩ সালে তিনি ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পটির অধীনস্থ রাজারামঘোষ গ্রাম উন্নয়ন সমিতির সদস্য হন। এরপর তিনি সঞ্চয়ের পাশাপাশি এ সমিতি থেকে যথাক্রমে ১০ হাজার, ২০ হাজার, ৩০ হাজার, ৫০ হাজার ও ৭০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে একটি খামার গড়ে তোলেন। তার খামারের শুরুটা ১০ জোড়া হাঁস ও ১০ জোড়া কবুতর দিয়ে। হাঁসের ডিম ও কবুতরের বাচ্চা বিক্রি করেই প্রথম তিনি লাভের মুখ দেখেন। এরপর উন্নত জাতের একটি গাভী লালন-পালন করে বেশ লাভবান হন। লাভের ১ লাখ ১০ হাজার টাকা দিয়ে প্রায় ৪০ শতকের একটি নাল জমি বন্ধক নিয়ে মাছের খামার শুরু করেন। শুষ্ক মৌসুমে তার খামারে বিভিন্ন ফসল ও শাকসবজি চাষাবাদ হয়।‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পের সুফলভোগী অনিমা রাণী দাস ২০১৬ সালে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে মহিলা ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন। তার পরিবারে স্বামী, ৪ ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছেন। অনিমা তার খামারের আয় দিয়ে পারিবারিক দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখার খরচ চালাচ্ছেন। লাভের টাকায় ইতোমধ্যে এক শতাংশ জমিও কিনেছেন। অনিমার খামারের গোয়ালঘরটি মেরামতের কাজ চলছে। আগামী ঈদুল আযহাকে কেন্দ্র করে কয়েকটি গরু মোটাতাজাকরণের পরিকল্পনা রয়েছে তার। এদিকে বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও হয়রানির শিকার হওয়া লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দক্ষিণ হামছাদী ইউনিয়নের পশ্চিম গোপীনাথপুর গ্রামের নাছিমা আক্তার সফলতা পেয়েছেন ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পের মাধ্যমে।

তিনি ২০১২ সালে প্রকল্পের অধীনস্থ ইয়ারপুর গ্রাম উন্নয়ন সমিতির সদস্য পদ লাভ করেন। বর্তমানে তিনি এ সমিতির ম্যানেজার। তার খামারে মৎস্য চাষের পাশাপাশি দেশী হাঁস-মুরগি পালন ও শাক-সবজি চাষাবাদ করা হয়। তিনি সেলাই মেশিন দিয়ে জামা-কাপড় তৈরি করেন। ২০১৬ সালে ব্রেন স্ট্রোক করে তার স্বামীর মৃত্যু হয়। এরপর থেকে সংসারের সকল কিছু তাকেই সামলাতে হচ্ছে। তার দুই মেয়ের পড়ালেখাসহ সংসারের যাবতীয় খরচ তাকেই বহন করতে হচ্ছে। খামারের আয় দিয়ে ভালোই চলছে এ বিধবার সংসার। ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পের মাধ্যমে কবির হোসাইন, অনিমা রাণী ও নাছিমা আক্তারের মতো লক্ষ্মীপুর জেলার হাজারও নারী-পুরুষ সঞ্চয়ী ও স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে।‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পের জেলা সমন্বয়কারীর কার্যালয়ের তথ্যমতে, ২০২০ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত লক্ষ্মীপুর জেলায় ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পের অধীনস্থ সমিতির সংখ্যা মোট ১ হাজার ৫৭১টি। এসব সমিতির মোট সদস্য সংখ্যা ৬৫ হাজার ৮৭ জন। এর মধ্যে নারী ৩৯ হাজার ১১০ জন এবং পুরুষ ২৫ হাজার ৯৭৭ জন। উপকারভোগী পরিবারের সংখ্যা ৪৫ হাজার ৬০৪টি। এ পর্যন্ত জেলায় আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মোট ৪৬ হাজার ২৬২টি খামার গড়ে তুলেছেন উপকারভোগীরা। বর্তমানে জেলায় প্রকল্পটির সদস্যদের সঞ্চয়ের পরিমাণ মোট ২০ কোটি ৩০ লাখ ৫৭ হাজার ৯১৯ টাকা। এ পর্যন্ত বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ৯৯ কোটি ১৪ লাখ ১৪ হাজার ৮০০ টাকা। এর মধ্যে ৫৬ কোটি ২ লাখ ২৬ হাজার ৭৯৬ টাকা ঋণ আদায় হয়েছে। তবে ঋণের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলেও এখন পর্যন্ত ২৪ কোটি ৮৭ লাখ ৬৬ হাজার ৫০৪ টাকা আদায় করা যায়নি বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। উপকারভোগীরা জানান, ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পের মাধ্যমেই তারা সঞ্চয় ও পরিকল্পিতভাবে পরিশ্রমে উদ্বুদ্ধ হয়। এরপর প্রশিক্ষণ ও সহজভাবে ঋণ পেয়ে সফলতা খুঁজে পায়। দারিদ্র বিমোচনে এমন বাস্তবমুখী একটি প্রকল্প গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানিয়েছেন তারা।

‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্প ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের জেলা সমন্বয়কারী পলাশ চক্রবর্তী বাসসকে বলেন, “শেখ হাসিনার উপহার, আমার বাড়ি আমার খামার-বদলে দিবে দিন, তোমার আমার” এ প্রতিপাদ্য বিষয়কে সামনে রেখে বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পটি চালু করে। এ প্রকল্পের মূল্য উদ্দেশ্য হলো- দারিদ্র বিমোচনের মাধ্যমে ভিক্ষুক ও হতদরিদ্র পরিবার গুলোকে আয়বর্ধক কাজে লাগিয়ে আত্মনির্ভরশীল করে তোলা। আমরা উঠান বৈঠকসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে তৃণমূলের নারী-পুরুষদের একত্রিত করে গ্রামে গ্রামে পল্লী উন্নয়ন সমিতি গঠন করি। এরপর সদস্যদের সঞ্চয় ও খামার গড়ে তুলতে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করি। এক পর্যায়ে সদস্যদের সঞ্চয়ের সমপরিমাণ সরকারি অনুদান দিয়ে সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা হয়। এ ঋণের টাকা যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে সদস্যরা যেন খামার গড়ে তুলতে পারেন, আমরা তা নিশ্চিত করতে নিরলসভাবে কাজ করছি। নতুন নতুন সমিতি গঠনের মাধ্যমে আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের সদস্য সংগ্রহ কর্মসূচি চলমান রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। জেলা প্রশাসক অঞ্জন চন্দ্র পাল বাসসকে জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১০টি বিশেষ উদ্যোগ সমূহের মধ্যে অন্যতম প্রধান উদ্যোগ ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্প। ইতোমধ্যে এ প্রকল্পের মাধ্যমে লক্ষ্মীপুর জেলায় অসংখ্য দরিদ্র নারী-পুরুষ সফলতার মুখ দেখেছেন। তারা প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজের বাড়িতে পরিকল্পিতভাবে খামার গড়ে তুলে স্বাবলম্বী হয়েছেন। ব্যক্তিগত সঞ্চয়, পরিশ্রম ও সরকারের আন্তরিক সহযোগিতা সুফলভোগীদের সফলতার পথ দেখিয়েছে। নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এ প্রকল্পের সকল কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তথ্য-বাসস

আজকের বাজার/ আখনূর রহমান