শখ এবং মননশীল চিন্তার সমন্বয়ে কান্তার হাতে তৈরি গহনা এখন দেশের গণ্ডি পেরুনোর অপেক্ষায়

‘হাতে তৈরি গহনা বা যে কোনো জিনিসে ব্যক্তিগত স্পর্শ থাকে। এই অনুভূতির প্রতি ছোটবেলা থেকে ভালো লাগা কাজ করত। একটা সময় এই ভালো লাগাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করি। এখন আমার হাতের তৈরি গহনা অনলাইন বা অফলাইনে শুধু বগুড়ায় নয়, রাজধানীতেও সমাদৃত’- সরকারি চাকরির পাশাপাশি একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প শোনালেন কান্তা চক্রবর্তী।

বগুড়ার আদমদিঘী উপজেলার চাঁপাপুরের মৃত কিরণ চক্রবর্ত্তী ও মন্দিরা চক্রবর্ত্তী দম্পতির কন্যা কান্তা চক্রবর্ত্তী (৩২)। বর্তমানে শহরের কাটনার পাড়া এলাকায় স্বামীর সাথে বসবাস করেন। সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে ২০১৫ সালে এম এ পাশ করেন। বর্তমানে মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের জেলা কার্যালয়ে কম্পিউটার ইন্সট্রাক্টর

পদে কর্মরত। কিন্তু তার সব কর্মতৎপরতা ছাড়িয়ে সুনাম কুড়িয়েছে তার নিজের হাতে তৈরি গহনা। একজন সরকারি কর্মকর্তার পাশাপাশি সফল উদ্যোক্তা হিসেবেও তিনি পরিচিতি পেয়েছেন।

কান্তা চক্রবর্তী বলেন, হাতে তৈরি জিনিসের প্রতি ছোটবেলা থেকেই এক আকর্ষণ অনুভব করতাম। শুরুটাও করেছিলাম কয়েকজন ফ্রেন্ড মিলে হাতে তৈরি বুটিকস পণ্য নিয়ে। অ্যাপ্লিক্স, পোশাক তৈরির কাজ করছিলাম। কিন্তু সেই টিমটা ভেঙে যাওয়ায় একটা বিরতি পড়ে।

তিনি  বলেন, হাতে তৈরি গহনার মধ্যে একটি ব্যক্তিগত স্পর্শ থাকে, যা মেশিনে তৈরি গহনায় পাওয়া যায় না। এটি কেবল একটি পণ্য নয়, বরং সৃজনশীলতার প্রকাশ। হাতে তৈরি গহনা পরিবেশবান্ধব ও টেকসই, যা আমার মূল দর্শনের সঙ্গে মেলে। কম্পিউটার ইন্সট্রাক্টর পদে চাকরিতে ঢোকার কয়েকবছর পর নিজের মূল শখের জায়গায় আবার ফিরে আসি।

শখ যেভাবে উদ্যোগে পরিণত হলো

‘প্রথমে নিজের জন্য কিছু গহনা অনলাইন থেকে কিনে সেগুলো খুলে দেখি। সেখান থেকে কিছু আইডিয়া এবং ইউটিউব থেকে কিছু আইডিয়া নিয়ে আমি প্রথম গয়না বানাই। আশেপাশের মানুষদের প্রশংসা পেয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিই। সে সময় মাত্র ১৮০০ টাকা মূলধন নিয়ে আমি এই কাজ শুরু করি।’

কান্তা ২০১৮ সালে স্বামীর পরামর্শ ও সহায়তায় নিজের প্রতিষ্ঠান ‘ক্লেজ’ ইংরেজি ‘KLAZE’ চালু করেন। নামকরণ সম্পর্কে কান্তা বলেন, এই নামের আলাদা কোনো অর্থ নেই। তবে এর সঙ্গে আমার ও আমার স্বামীর পূর্বপুরুষদের স্পর্শ রয়েছে। আমাদের পূর্বপুরুষদের নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে এই নামটি আমরা ঠিক করি। পরে ২০১৯ সালে পুরোদমে ‘ক্লেজ’ যাত্রা শুরু করে। এরপর গহনা তৈরিকে ব্যবসায় রূপ দিলাম।

তিনি জানান, গত পাঁচ বছরে ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অনেক ধরণের প্রতিবন্ধকতা সামনে এসেছে। এরমধ্যে মহামারী করোনাভাইরাস অন্যতম। কান্তা চক্রবর্তী নিজেও দুবার আক্রান্ত হয়েছেন।

কান্তা বলেন, করোনায় আমাদের স্বাভাবিক জীবন স্থবির হয়ে পড়েছিল। আর্থিক সমস্যায় পড়েছিলাম। তবে অনলাইন প্লাটফর্ম থাকায় সে সময় ভালো সুবিধা পেয়েছি। ব্যবসার পরিচিতিও বেড়েছে। পাঁচ বছরে এখন ‘ক্লেজ’ নিয়ে আমি অনেক আত্মবিশ্বাসী।

উদ্যোগের বিশেষত্ব

কান্তার তৈরি পণ্যের বিশেষত্ব হলো প্রতিটি পণ্য হাতে তৈরি, যা ইউনিক ও পরিবেশবান্ধব। তিনি গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী কাস্টমাইজড পণ্যও তৈরি করে দেন। ফলে গ্রাহকরা ব্যক্তিগত টান অনুভব করেন।

কান্তার তৈরী গহনা মাঝেমধ্যেই  কেনেন শহরের কলোনি এলাকার গৃহিনী মহসিনা আক্তার। তিনি বাসসকে বলেন, ‘কান্তার হাতে বানানো চুড়িগুলো অসাধারণ। কাউকে উপহার দেয়ার জন্য ওর পণ্য সবচেয়ে সুন্দর। কান্তা অনলাইনে ব্যবসা করে, তবে আমরা সরাসরিই কিনি।’

জেলার গন্ডি ছাড়িয়ে রাজধানীতে ‘ক্লেজ’

কান্তা বলেন, সম্প্রতি ঢাকার ধানমন্ডি ও নুরজাহান রোডে দুটো আউটলেটে আমার তৈরী গহনা নিয়মিত সরবরাহ করছি। এ ছাড়া আরও কয়েক জেলায় আমার পণ্য যাচ্ছে। এখন বছরে গড়ে আড়াই থেকে ৩ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হচ্ছে।

এসব আউটলেট থেকে সরাসরি ক্লেজ-এর গহনা কেনা যায়। আবার যারা অনলাইনে কিনতে চান তাদের জন্য রয়েছে অনলাইন পেইজ https://www.facebook.com/share/1ZCgE8qxUg/?mibextid=wwXIfr.

‘ক্লেজ’-এর ভবিষ্যত ভাবনা

ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে কান্তা বলেন, আমার স্বপ্ন ‘KLAZE’কে এমন একটি ব্র্যান্ডে পরিণত করা যা শুধু বাংলাদেশে নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সমাদৃত হবে। পাশাপাশি আরও অনেক নারীকে স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ নিতে চাই। আগামী বছর ক্লেজের একটি নিজস্ব প্রোডাকশন হাউজ তৈরি করতে চাই, যেখানে অনেক নারী একত্রে কাজ করতে পারবেন।

নিজের ব্যবসার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন স্কিল ডেভেলপমেন্ট ট্রেনিং দিয়ে থাকেন। এর মধ্যে রয়েছে গহনা তৈরির প্রশিক্ষণ, বেসিক কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, সক্ষমতা বিনির্মাণ প্রশিক্ষণ ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা কার্যক্রম। এ পর্যন্ত তিনি প্রায় ১০০ নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।

সাফল্যের সিঁড়িতে কান্তার পথ চলা

একজন সরকারি চাকরিজীবী বা একজন তরুণ উদ্যোক্তাই শুধু নন কান্তা। তিনি একজন সফল প্রশিক্ষকও।  একজন ভালো প্রশিক্ষক হয়ে ওঠার জন্য তিনি বিভিন্ন সময়ে দেশি বিদেশি সংস্থা থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

২০২২ সালে চায়না সরকারের ক্রস বর্ডার অনলাইন সেশন এ অংশগ্রহণ নেন। চার মাসব্যাপী এই প্রোগ্রাম এর সবগুলো সেশনে অংশ নিয়ে সাফল্য সনদ অর্জন করেন। ২০২৩ সালে তিনি গ্রীনটেক ফাউন্ডেশন এর দুই দিনের গ্রুমিং সেশনে অংশ নেন। ২০২৪ এর শেষে নুশু নেটওয়ার্ক (Nushu Network) এর ৫ সপ্তাহের ভার্চুয়াল শী লিডস (She Leads  Programme) কর্মসূচিতে অংশ নেন। ২০২৪ এর জুন মাসে একমাত্র বাংলাদেশি বেনিফিশিয়ারি হিসেবে লাওসে  অনুষ্ঠিত ‘এ্যাকসিলারেটিং কোভিড রিকভারি ইন দ্যা এশিয়া প্যাসিফিক থ্রু সাউথ-সাউথ এ্যান্ড ট্রাইয়াংগুলার কো-অপারেশন’ (Accelerating Covid-Recovery in the Asia-Pacific through South-South and Triangular Cooperation) আয়োজিত দুইদিনের সামারি ওয়ার্কশপে অংশ নেন।  ২০২৪ সালের মার্চে  বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সুইডেনের রাজকন্যা ভিক্টোরিয়ার  আগমন উপলক্ষ্যে ‘ইনোভেট টুগেদার ফর জিরো ডিজিটাল ডিভাইস’ অনুষ্ঠানে প্রোডাক্ট শো-কেসিং অনুষ্ঠানেও  উপস্থিত ছিলেন কান্তা।

এছাড়াও ইউএস অ্যাম্বেসির অর্থায়নে ব্র্যাকের একটি প্রকল্পের আওতায় উদ্যোক্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এক বছরের প্রশিক্ষণ নেন। এই প্রশিক্ষণে সারাদেশে ৯০ জনকে সিলেক্ট করে সংস্থাটি। এতে বগুড়ার মধ্যে কান্তা চক্রবর্তীই নির্বাচিত হন।
তরুণদের উদ্দেশ্যে কান্তা

তরুণ উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে কান্তা চক্রবর্তী বলেন, ‘স্বপ্ন দেখুন ও সেটাকে বিশ্বাস করুন। আর অবশ্যই কাজ শুরু করুন। সঠিক সময়ের অপেক্ষা করবেন না। ব্যর্থ হলে ভেঙে না পড়ে তা থেকে শিখুন ও কখনো হাল ছাড়বেন না। টাইম ম্যানেজমেন্ট শিখুন, এটা খুব জরুরি ও পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করুন। নিজেকে নিজে আত্মবিশ্বাসী হিসেবে গড়ে তুললে আপনি অবশ্যই সফল হবেন।’  (বাসস)