শিকার থেকে সচেতনতা প্রচারক: মালিহার লড়াইয়ের গল্প

তেত্রিশ বছর বয়সী মালিহা (ছদ্মনাম) একসময় কাজ করতেন যৌনকর্মী হিসেবে। তার জীবন কখনোই সহজ ছিল না। মাত্র দশ বছর বয়সে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি তার বাবা, মা ও এক ভাইকে হারান। এরপর তাকে রাখা হয় মামা বাড়িতে। সেখানে তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তার নানী। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, মালিহা বয়স যখন মাত্র তের বছর, তখন তার নানীও মারা যান। নানীর মৃত্যুর পর শুরু হয় তার ওপর নির্যাতন।

নানী যতদিন বেঁচে ছিলেন, মালিহা ছিল আদর-সোহাগের মধ্যে। কিন্তু নানীর মৃত্যুর পর তাকে দিয়ে সব কাজ করানো হতে থাকে এবং পান থেকে চুন খসলেই শুরু হতো মারধর। এক পর্যায়ে মামা বাসায় না থাকলে মামী তার ওপর নির্যাতন চালাতেন।

একসময় তার সাথে পরিচয় হয় এক আংকেলের। সেই আংকেল তাকে গার্মেন্টে কাজ করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, ওই কথিত মামা তাকে দালালের হাতে বিক্রি করে দেয়। দালাল মালিহাকে বাধ্য করে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতে। এর পর ধীরে ধীরে মালিহা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে।

একদিন, গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার পর, মালিহা জানতে পারেন যে তিনি এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত। বর্তমানে তিনি একটি স্থানীয় এনজিওতে কাজ করছেন এবং নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছেন। তার প্রধান কাজ ভাসমান যৌন কর্মীদের মধ্যে এইচআইভি সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা।

দেশে এইচআইভি/এইডসের পরিস্থিতি:

বাংলাদেশে এইচআইভি/এইডসের পরিস্থিতি উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। ২০২১ সালের ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে মোট ৮,৭৬১ জন এইচআইভি আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ২০২১ সালে ৭২৯ জন নতুনভাবে আক্রান্ত হয়েছেন, এবং ২০২১ সালেই ২০৫ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। দেশে বর্তমানে প্রায় ১২,৪২২ জন এইচআইভি আক্রান্ত রোগী রয়েছেন, যার মধ্যে ২,২৮১ জন মারা গেছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিওএইচও)’র সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালের শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩৭.৭ মিলিয়ন মানুষ এইচআইভি আক্রান্ত, এবং ২০২০ সালে প্রায় ৬,৮০,০০০ আক্রান্ত ব্যক্তি মারা গেছেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, আক্রান্তদের মধ্যে অধিকাংশই ১৯ থেকে ৪৯ বছর বয়সী, এবং পুরুষদের সংখ্যা নারীদের তুলনায় বেশি। এছাড়া, দেশে আক্রান্তদের অধিকাংশই শিরাতে মাদক গ্রহণ করতেন, এবং অনিরাপদ যৌন সম্পর্কও এর জন্য দায়ী।

সচেতনতার বৃদ্ধি ও সরকারি পদক্ষেপ:

প্রতি বছর ১ ডিসেম্বর বিশ্ব এইডস দিবস পালিত হয়, যা এই রোগের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টি এবং এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য এক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে। সরকারি উদ্যোগের অংশ হিসেবে, বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে এইডস নির্মূল করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে এবং দেশের জেলা পর্যায়ে এইচআইভি পরীক্ষার পরিকল্পনা রয়েছে। যদিও বিশেষায়িত হাসপাতালের অভাব, বিশেষ করে এইডস রোগীদের জন্য চিকিৎসার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে, তবুও মহাখালী সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল একমাত্র স্থান যেখানে এই রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়।

সম্প্রতি, কিছু অঞ্চলে যেমন সিরাজগঞ্জে, এইডস রোগী শনাক্তের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। গত এক বছরে সেখানে ১৪৪ জন এইচআইভি আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে, যার মধ্যে ৯৮% মাদকাসক্ত।

প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা:

এইচআইভি/এইডসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সচেতনতা সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। জনগণকে নিরাপদ যৌন আচরণ এবং মাদকাসক্তদের জন্য পুনর্বাসন সম্পর্কে শিক্ষা দিতে হবে। এর পাশাপাশি, নির্দিষ্ট জনগণের জন্য যেমন যৌনকর্মীরা, মাদকাসক্তরা, তাদের স্বাস্থ্য সেবার পরিসর বাড়ানো জরুরি।

এছাড়া, মাদকাসক্তি এবং এইডসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলিরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যেমন, ইউএনএআইডি ও ডব্লিউএইচও বাংলাদেশে এইডস নিয়ন্ত্রণে নানা ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।

সামাজিক দৃষ্টিকোণ:

এইডস সম্পর্কে সামাজিক স্টিগমা বা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি খুবই গভীর। অনেক ক্ষেত্রে এই রোগের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের অবহেলা এবং বঞ্চনা করা হয়, যা তাদের চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনে বাধা সৃষ্টি করে। সমাজে এই রোগের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন এবং রোগীদের প্রতি সহানুভূতি বাড়ানো একান্ত প্রয়োজন।

এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তিদের সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া এবং তাদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া সহজতর করতে হবে, যাতে তারা সমাজে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে।

সর্বশেষ তথ্য:

দেশে গত ৪ বছরে এইডস রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত নতুন ১,৪৩৮ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এইডস রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, বিশেষ করে ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ ৪০৬ জন শনাক্ত হয়েছে।

মাদকসেবী এবং অনিরাপদ যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে এই রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি, বিভিন্ন এনজিও ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বিষয়টির গুরুত্ব তুলে ধরে জনগণকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন।

উপসংহার:

এইচআইভি/এইডস একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এর বিস্তার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। মাদকাসক্তি, অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক এবং অন্যান্য উপসর্গের কারণে সংক্রমণ দ্রুত ছড়াচ্ছে। তবে, সচেতনতা বৃদ্ধি, সঠিক তথ্য ও নিরাপদ যৌন আচরণ এবং মাদকাসক্তদের জন্য প্রয়োজনীয় সেবা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে, এই মহামারী থেকে অনেকটাই মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

সরকারের এই রোগের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি, সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের সচেতনতা ও একযোগে কাজ করার মাধ্যমে এইডসের বিরুদ্ধে কার্যকর লড়াই করা সম্ভব। (বাসস)