শিশুদের মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে করোনা

বর্তমার বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত শব্দ ‘করোনা ভাইরাস’। ভাইরাসটি পুরো বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। ইতোপুর্বে আর কোন কিছু বিশ্বকে এতটা নাড়া দিয়েছে কিনা সন্দেহ। বিশ্ব তথা মানব সমাজের এমন কোন ক্ষেত্র নেই, যেখানে প্রভাব ফেলেনি করোনা। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত করোনায়। তবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। বছরের শুরুতে শিক্ষা জীবনে পা রেখেছিল রাজিহার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্ষুদে শিক্ষার্থী স্বপ্না রায় (৫)। বড় বোনের সঙ্গে সে আড়াই মাস স্কুলে যেতে পেরেছে। পড়াশোনা রীতিমত অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু করোনা ভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন তাকে ঘরে পড়তে বসানো মুশকিল হয়ে পড়েছে। তার মা-বাবা জানান, করোনা শুরুর আগে প্রতিদিন স্বপ্না স্কুলে যেত, বাড়িতে পড়াশোনা করত। বেশ আগ্রহের সাথেই সে লেখাপড়া করত । কিন্তু করোনার কারণে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন তাকে পড়তে বসানো বেশ কঠিন হয়ে গেছে।
একই বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী তনুশ্রী (১০)। প্রাথমিকের গন্ডি পেড়িয়ে মাধ্যমিক স্তরে যেতে তার প্রস্তুতি ছিল বিগত বছরগুলোর চেয়ে আরো ভাল। করোনার কারণে স্কুল বন্ধ। তারপর পিইসি পরীক্ষা না হওয়াতে পড়াশোনায় মনোযোগ কমে গেছে বলে জানালেন তার বাবা। পাশাপাশি আচরণগত পরিবর্তনও এসেছে বলে জানান।
বছরের শুরুতে নতুন বই হাতে পেলেও শিশুরা বেশিদিন বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়নি। করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুদের পড়াশোনা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমনি তারা মানসিকভাবেও ভালো নেই। অভিভাবক ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ওপর।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মফিজুর রহমান বলেন, ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনার সাথে সাথে এই সময়টিতে শিক্ষাগ্রহণের পাশাপাশি তারা সামাজিক নানা আচরণও শেখে। এক্ষেত্রে স্কুলের গুরুত্ব অনেক বেশি। প্রতিটি স্কুলে শিশুদের পড়াশোনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক নানা আয়োজন থাকে। এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় সে সব বিষয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই শিশুদের পড়াশুনা ক্ষতিগ্রস্তের পাশপাশি সবচেয়ে ভাবনার বিষয় যে, তারা মানসিকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছে।’
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, করোনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই দীর্ঘ ছুটিতে শিশু শ্রম বাড়বে। মেয়ে শিশু ঝরে পড়বে। কারণ অনেক অসচ্ছল পরিবার তাদের সন্তানদের কাজে যুক্ত করে দেবে। অন্যদিকে মেয়ে শিশুদের বিয়ে দেবে।
বরিশাল জেলার আগৈলঝড়া উপজেলার বাশাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুস সালাম বলেন, ‘শিশুদের সঙ্গে দেখা হলেই তারা বলে স্কুল খুলবেন কবে স্যার। তাদের মনে হয় বাড়িতে ভালো লাগে না। শিশুদের নিয়েই আমাদের সময় কাটে। এখন তা সম্ভব হচ্ছে না। অন্য দিকে তাদের পড়াশোনার ব্যাপক ঘাটতি হচ্ছে।’ লম্বা ছুটির কারণে তাদের শিখনে দুর্বলতা বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রাক প্রাথমিকে শিশুরা যা শিখেছে তা সব ভুলে যাবে। আর তাদেরকে পুনরায় স্কুলে ফেরাতেও অনেক সমস্যা হবে। তার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো শিক্ষার মান অনেক পিছিয়ে গেছে। তা ফিরিয়ে আনতে শিক্ষক ও অভিভাবককে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
এদিকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে স্কুল বন্ধকালীন গ্রামের শিশুরা প্রাকৃতিক পরিবেশ পেলেও শহরের শিশুরা একেবারেই গৃহবন্দি। রাজধানী উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের শিক্ষক গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘এই পরিস্থিতিতে আমরা অনলাইনে যদিও ক্লাস নিচ্ছি, কিন্তু মূল দায়িত্ব তাদের (শিশু) পরিবারের। অভিভাবকদের নজর রাখতে হবে তার শিশুর পড়াশুনা ও আচরণের প্রতি। কারণ এ সময় শিশুদের মানসিক বিকাশ ঘটে।’
এ প্রসঙ্গে গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি শিশুরা সামাজিক শিক্ষা পেয়ে থাকে। পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে শিক্ষার্থীদের বড় প্রত্যাশার জায়গা থাকে খেলাধুলা ও বন্ধুমহল।’
তিনি বলেন, ‘অনেক শিশু প্রথমে স্কুলে যেতে চায় না। কিন্তু যেতে যেতে এক সময় স্কুলে তার বন্ধু তৈরি হয়। যাদের সঙ্গে খেলাধুলা করতে পারে। যার ফলে শিশুদের কাছে আনন্দের জায়গা হয়ে ওঠে স্কুল। এখান থেকে সামাজিক আচরণেরও পরিচয় ঘটে।’
করোনার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘ ছুটির কারণে এসব শিশুদের মানসিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার কয়েকদিন পরেই গত ১৭ মার্চ থেকে সকল পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়, যা এখনো চলছে। এ কারণে এরই মধ্যে সব ধরনের পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ না কমলে চলতি বছরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না খোলারও ইঙ্গিত দিয়েছে সরকার।