‘শুধু সার্টিফিকেট নয়, বাস্তবমুখী শিক্ষার গুরুত্ব দিতে হবে’

অধ্যাপক ড. ইয়াসমীন আরা লেখা : বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাটা একেবারে নতুন। প্রায় ১৫০ বছর আগে একজন ব্যক্তি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়টি শুরু করেছিলেন অ্যামেরিকায়।  যেখান থেকে ২১ জন নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এ জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সংশয় থাকার কোন কারণ নেই।

বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অনেকে ভালো করছে। এমনকি দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইতে এমন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে যারা গবেষণার ক্ষেত্রে তাদের চাইতে অনেক এগিয়ে আছে। মানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশি গবেষণা হচ্ছে। আর মানের ক্ষেত্রে যদি বলি, দেশের কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মানের দিক থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইতে অনেক এগিয়ে আছে। এখন কথা হচ্ছে বাকিরা কি করছে?

বাকিদের মধ্যে যারা চেষ্টা করছে কোয়ালিটি দেওয়ার জন্য এবং প্রতিদিন তারা উন্নতি করছে। এছাড়া মান বাড়ানোর জন্য সরকার থেকে অনেক চাপ রয়েছে। যারা কোয়ালিটি দিতে পারছে বা দিবে এমন মানসিকতা আছে তারা এই সেক্টরে টিকে যাবে। আর যাদের ইচ্ছে নেই এই সেক্টরে সেভাবে কোয়ালিটি দেওয়ার জন্য তারা কিন্তু মার্কেট থেকে আপনা আপনিই ঝরে পড়বে। এটিও আছে যে, সব বিশ্ববিদ্যালয় তো একই মানের হয় না। কিছু আছে ভালো মানের শিক্ষা দেয়, আবার কিছু মাঝারি, আবার কিছু আরেকটু নিচে, কিন্তু ন্যূনতম কোয়ালিটি যারা দিতে পারবে না, তাদের এই সেক্টরে থাকা উচিত না বলে আমি মনে করি।

একজন শিক্ষার্থীকে দেওয়ার মতো ন্যূনতম কোয়ালিটি যদি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের না থাকে তাহলে উপকার তো হবেই না বরং ক্ষতি করবে বলেই আমি মনে করি। আর উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে বলতে গেলে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তারা আগে থেকে শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হল। ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয়টি অনেকগুলো বছর অতিক্রম করলো। ইতোমধ্যে ৫টি সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের চুক্তি আছে। আমাদের শিক্ষার্থীরা ইচ্ছে করলেই বিশ্বের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রেডিট ট্রান্সফার করে সেখানে পড়াশোনা করতে পারে। শিক্ষার্থীরা পাস করার পর কেউ ঘরে বসে থাকে না। সকলেই কোথাও না কোথাও কাজ করছে। এখানে ভালো লাগার বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশে যে গণিত অলিম্পিক প্রতিযোগিতা হয়, বেসরকারি ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় মিলে সেখানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে মেয়েরা পর পর ৩ বার প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয়েছে।

এর কারণ হচ্ছে উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কোয়ালিটি অনেক ভালো। এখানে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো রকমের ছাড় দেওয়া হয় না। এখানে কমিটি যেভাবে সিলেকশান দেয় সেভাবে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। যে কারণে ভালো শিক্ষক শ্রেণি কক্ষে আসলে শিক্ষার্থীরা ভালো শিখতে পারে। তারই একটি নমুনা আমরা দেখছি গণিত অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় আমাদের সাফল্য।

আমাদের সিএসই বিভাগের এক শিক্ষার্থী সম্প্রতি একটি মোটরযান আবিস্কার করেছে। যেটি তেল ও গ্যাস বিহীন অবস্থায় সোলারের মাধ্যমে চলবে। এতে সারাদিনে খরচ হবে মাত্র ১০ টাকায়। আবার আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এক ছাত্র জিআরই পরীক্ষায় বিশ্বের মধ্যে ১০তম হয়েছে। এছাড়া আমরা নিয়মিত অনেক আন্তর্জাতিক মানের কনফারেন্স করছি।

আমাদের শিক্ষার্থীরা ক্লাসে যেমন ভালো করছে, তেমনি বাইরেও ভালো করছে। দেশের বাইরে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করে দেশের জন্য সুনাম অর্জন করছে। এছাড়া দেশের দুর্যোগ পরিস্থিতিতে তারা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে।

বেসরকারি কলেজ ছিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। সেখানে দেখা গেল যে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অনেক সমস্যা। তার মধ্যে অন্যতম সেশনজট। এতো বেশি সেশনজট ছিল যে, শিক্ষার্থীরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। সে কারণে আমাদের মাথায় এলো বেসরকারি কলেজ বাদ দিয়ে যদি আমরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করতে পারি, তাহলে সেশনজট আর থাকবে না। সেভাবেই আমাদের এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। আমাদের সব কিছু প্রযুক্তির মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। কবে ক্লাস, কবে বন্ধ, পরীক্ষার সময়, সব কিছু তারা প্রযুক্তির মাধ্যমে দেখতে পারছে।

আমরা মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার সুযোগ করে দিচ্ছি। আমাদের টিউশন ফ্রি অনেক কম। দেশের অন্যান্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়তে গেলে যেখানে টিউশন ফ্রি নেওয়া হয় ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা, সেখানে আমাদের উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র সাড়ে ৩ থেকে পৌনে ৪ লাখ টাকায় বিবিএ পড়তে পারছে ছাত্র-ছাত্রীরা। আবার এখানে যে সকল শিক্ষক রয়েছে তারা অত্যন্ত মান সম্পন্ন। ৮ থেকে ১০ লাখ টাকায় যারা শিক্ষা দিচ্ছেন তাদের শিক্ষকদের সঙ্গে আমাদের শিক্ষকদের মান কিন্তু এক।

বিবিএ ডিপার্টমেন্টে আমাদের ৮ জন পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন শিক্ষক রয়েছেন। এখন বিষয় হচ্ছে, আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের ভালো শিক্ষক দিচ্ছি, কোয়ালিটি শিক্ষা দিচ্ছি। আবার অন্যদিকে শিক্ষকদের ভালো সম্মানি দিচ্ছি, কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে টিউশন ফি নেওয়া হচ্ছে কম। এর মাধ্যমে সাধারণ পরিবারের ছেলে-মেয়েরা ডিগ্রিগুলো গ্রহণ করতে পারছে।

উত্তরায় থার্ড ফেইজের সঙ্গে আমাদের ১০ বিঘা জমি রয়েছে স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য। রাজউক থেকে এই জমি পেয়েছি আমরা। ইতিমধ্যে ৫টি বিভাগ প্রায় ১ বছর ধরে সেখানে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বাকি বিভাগগুলো ধীরে ধীরে সেখানে চলে যাবে।

শুধু সরকারি বা বেসরকারি বাদ দিয়ে যদি আমি বলি, সারা বাংলাদেশে দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। কিছুদিন আগে আমি দুবাইতে একটি হোটেলে দেখলাম, সেখানে সমান যোগ্যতা সম্পন্ন একজন বাংলাদেশি ও একজন ইন্ডিয়ান। কিন্তু তাদের পারিশ্রমিক আলাদা। বাংলাদেশির পারিশ্রমিক কম, ইন্ডিয়ার বেশি। ইন্ডিয়া থেকে যিনি গিয়েছেন তিনি বিছানা ঠিক করছেন, আর বাংলাদেশ থেকে যিনি গিয়েছেন তিনি টয়লেট ও ফ্লোর পরিস্কার করছেন। তার মানে আমার দেশ থেকে যিনি গিয়েছেন তার ট্রেনিং ভালো না হওয়ায় তার পারিশ্রমিক কম। আবার ভালোভাবে কাজও করতে পারছেন না।

অধ্যাপক ডক্টর ইয়াসমীন আরা বলেন, সব সেক্টরে আমাদের এই একই অবস্থা। এ জন্য দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা প্রয়োজন হয়ে পরেছে। শুধু শিক্ষা সেক্টরে নয়, সব সেক্টরে। আমি মনে করি না প্রতিটি মানুষের মাস্টার্স ডিগ্রির প্রয়োজন আছে। কেননা আমি মাস্টার্স করলাম, আমার অনেক সার্টিফিকেট আছে কিন্তু বাস্তবে কাজে লাগাতে পারছি না সে সার্টিফিকেটের কোনো মূল্য নেই। আমি মনে করি এতো সার্টিফিকেট অর্জন না করে যদি হাতে কলমে শিক্ষা নিয়ে, বাস্তবমুখী শিক্ষা নিয়ে সেটার উপর সে ভালো কোনো কাজ করে সেখানে ভালো কিছু সে অর্জন করতে পারবে।  সে দিকে মনযোগী হওয়া মনে হয় খুব প্রয়োজন।

উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয় শিগগিরই স্থায়ী ক্যাম্পাসে চলে যেতে চায়। সেই পথেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। কোয়ালিটি শিক্ষা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে আমার কোনো রকম ছাড় দেই না।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা শেষ করেই দেশের বিভিন্ন ব্যাংক, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানসহ দেশ এবং দেশের বাইরে সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। ফুল স্কলারশিপ নিয়ে দেশের বাইরে মাস্টার্স করছে।

অধ্যাপক ড. ইয়াসমীন আরা লেখা

উপ-উপাচার্য, উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়।

আজকেরবাজার/জাকির/এস/আরএম