শুল্ক কমলে সাশ্রয়ী দামে গাড়ি পাওয়া যাবে

অটোমোবাইল

দিলীপ ব্যানার্জী:

গ্রামের যেখানে আমরা শো-রুম দিতে পারব না সেখানে আমরা ছোট আকারের এক্সটেনশন কাউন্টার দিব। আমরা নিজেরাই ডাইরেক্ট সেলিং এজেন্ট দিব। যদি আমি ওয়ার্কশপ না দিতে পারি তাহলে আমি স্যাটেলাইট ওয়ার্কশপ খুলব। যেখানে আমি তাও পারব না সেখানে আমরা মোবাইল সার্ভিস প্রোভাইড করব। যেখানে মোটর সাইকেলে করে আমাদের মেকানিক কাস্টমারের বাসায় গিয়ে সেবা দিয়ে আসবেন।

র‌্যাংগস মটরস আসলে র‌্যাংগস গ্রুপের কনসার্ন কোম্পানি। বিগত ৩৫ বছর ধরে এই গ্রুপ অব কোম্পানিটি সুনামের সঙ্গে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করছে। এ দেশে তাদের আরও অনেক ব্যবসা রয়েছে। র‌্যাংগস্ অটোমোবাইল গাড়ির ব্যবসা করে। আমরা সাধারণত বাণিজ্যিক গাড়ির ব্যবসা করি। ভারতের মাহিন্দ্রা এন্ড মাহিন্দ্রা ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছি। তাদের হয়ে বাংলাদেশের পরিবেশক হিসেবে আমরা কাজ করছি। প্রায় ১৫ বছর ধরে আমরা এ ব্যবসার সঙ্গে আছি।

আমরা জানি, কেনো দেশকে যদি উন্নয়নের দিকে যেতে হয়, তার মধ্যে দু’তিনটি ব্যাপার গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে একটা হলো রাস্তাঘাটের উন্নয়ন,অন্যটি ট্রান্সপোর্ট। স্বল্প মূল্যে যদি আমি আমার গাড়ি ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিতে চাই, তাহলে আমাকে গাড়ির মূল্য কমাতে হবে, কম দামে গাড়ি আমদানি করতে হবে। পাশাপাশি ক্রেতাকে কম দামে যন্ত্রাংশের সেবাও নিশ্চিত করতে হবে। কমার্শিয়াল গাড়িগুলোর মধ্যে আমরা দেড়টনের গাড়ি বিক্রি করি। এর মধ্যে ম্যাক্সিমা মডেলের গাড়ি আছে। এসব গাড়ি ৮০০ থেকে সাড়ে ৮০০ কেজি পর্যন্ত মালামাল বহন করতে পারে। এর সঙ্গে জিপ ও সুপ্রও আছে। এগুলো সবই দেড় টন ওজনের পণ্য পরিবহনের গাড়ি। রয়েছে বলেরো গাড়ি। বলেরো পিকআপও বিক্রি হয়। বলেরো কন্টেইনার ও ডেলিভারি ভ্যানের মতো গাড়িও তৈরি করি আমরা।

এই গাড়িগুলো যদি আমরা দেশেই বানাই, তাহলে আমাদের খুব সুবিধা হবে। এতে করে ক্রেতারা কম দামে গাড়ি কিনতে পারবেন। সে ভাবনা থেকে আমরা দেশেই এসেমব্লিং প্ল্যান্ট চালু করেছি। গত দুমাস আগে সোনারগাঁয়ে এই প্ল্যান্ট উদ্বোধন হলো। সব ধরনের গাড়িই আমরা সেখান থেকে এসেম্বল করব। ভারত থেকে গাড়ির যাবতীয় যন্ত্রাংশ এখানে নিয়ে এসে গাড়ি তৈরি করছি। এর ফলে দেশের বেকার যুব সমাজের চাকরির সংস্থান হচ্ছে। যখন আমরা একটা গাড়ি এসেম্বল করি তখন আমাদের অনেক রকমের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে ফেব্রিকেটর দরকার হয়, ডেন্টিং-পেন্টিংয়ের দরকার হয়, মেকানিকস দরকার হয়। এভাবে বিভিন্ন বিভাগে অনেক ধরনের শ্রমশক্তির দরকার হয়। এখনও সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে না পারলেও আশেপাশে অনেকগুলো এনসেলারিং ইউনিটকে আমরা কাজ দেব। এতে করে তাদেরও আয়ের সুযোগ হবে, বেকার সমাজ কাজ পাবে। সার্বিকভাবে দেশের উন্নয়নে অংশগ্রহণ করতে চাই আমরা। বড় কথা, দেশে এখন যে দামে গাড়ি বিক্রি করছি তার চেয়ে কম দামে আমরা ক্রেতাদের কাছে গাড়ি তুলে দিতে পারব। এর মাধ্যমে সুবিধার পাশাপাশি আমরা সারা দেশে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে পারব।

গাড়ির ব্যাবসা ছাড়াও আমরা আরো অনেক ব্যবসা করছি। আমরা ডিপ-সী-ফিসিং করছি, ফার্মাসিউটিক্যালসে আমরা আছি, ইন্টেরিওর আছে, আইসার মটর্সের পরিবেশকও আমরা। মাহেন্দ্রার মতো একসময় আইসারেরও এসেমব্লিং প্ল্যান্ট করার ইচ্ছা আছে আমাদের। আমরা মনে করি, দেশে যত সহজে ট্রান্সপোর্ট সমস্যার সমাধান হবে ও রাস্তাঘাটের উন্নতি হবে, সে হারে দ্রুত দেশের উন্নয়ন হবে।

বাংলাদেশ হলো ট্রেডিং কান্ট্রি, যেখানে ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের ভিত অনেক ছোট। এখানে যদি আমরা মেইড ইন বাংলাদেশ নামে কোনো কিছু বাজারজাত করি তাহলে দেশের লাভ হবে। দেশের মধ্যে স্বল্প মূল্যে পণ্য কিনতে পারবেন ক্রেতারা। ভালো পণ্য পাবেন, সার্ভিস পাবেন। প্রোডাক্টের কোনও সমস্যা থাকলে তারা আমাদের বলতে পারবে যে এতে সমস্যা রয়েছে। বাইরে থেকে কোনো কিছু আমদানি করলে কেনো ওয়্যারেন্টি, গ্যারান্টি রাইটস্ থাকে না। তাছাড়া যতদিন আমরা আমাদের দেশের র-ম্যাটারিয়াল দিয়ে তৈরি করে গাড়ি উৎপাদন করতে পারছি না, ততদিন ধরে এই শিল্পের উন্নয়নে সরকার যদি ডিউটি ফ্রি আমদানির অনুমোদন দিত তাহলে ভালো হতো। তা হলে সার্বিক উৎপাদন খরচ কম হলে ক্রেতারা কম দামে গাড়ি কিনতে পারতেন। তারা সন্তুষ্ট থাকতেন । আমরা তো এখন বিলাসী গাড়ির ব্যবসা করছি না। এটা কমার্শিয়াল গাড়ির ব্যবসা, যে কারণে একজন ক্রেতা যখন একটা গাড়ি কিনবেন তিনি প্রথমেই চিন্তা করবেন, কবে তিনি তার বিনিয়োগ করা টাকা ফেরত পাবেন। একজন ব্যবসায়ী তার গাড়ি দিয়ে বিভিন্ন পণ্য ভাড়ায় পরিবহন করেন। সেখানে তাকে চিন্তা করতে হয় দিনে কতবার আপডাউন করবে,কতবার সে ট্রিপ দিতে পারবে। সে অনুযায়ী তার আয়ের মাধ্যমে এইসব পিকআপ, হিউম্যান হলারের ক্রয় মূল্য কবে ওঠে আসবে সেটা চিন্তা করবেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী। এর মাধ্যমেই যে হারে রিটর্ন আমরা আশা করেছিলাম সে অনুযায়ী তা স্লো হয়ে যাচ্ছে। আসলে আমাদের মূল উদ্দেশ্য হলো, ক্রেতা সন্তুষ্টি। সে লক্ষ্যেই আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। সরকার যদি এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসে, তাহলে আমরা ক্রেতাদের চাহিদা অনুসারে তাদের পছন্দের সর্বোচ্চটা দিতে চেষ্টা করব।

কিছুদিন আগে আমি সারা দেশ ঘুরেছি। বেশ কিছু সিটি করপোরেশনের মেয়রের সঙ্গে কথা হলো। আমি দেখেছি অনেক এলাকায় ছোট্ট ছোট্ট গলি আছে যেখানে রিক্সা ভ্যান দিয়ে গার্বেজ পরিষ্কারের কাজ হচ্ছে। এটা পরিবেশবান্ধব নয় এবং এর ফলে পরিবেশ দুষণ হচ্ছে। আমরা যদি প্রতিটি সিটি করপোরেশনকে এইসব গলি দিয়ে গার্বেজ পরিবহন করতে পারে, এমন ধরনের সহজ গাড়ি তৈরি করে দিতে পারি, তাহলে সমস্যার অনেকটা সমাধান হয়। আসলে একটা গাড়ি অনেকগুলো পার্টস দিয়ে তৈরি হয়। গাড়ি বানানোর পর আমরা যে তার ওপর কাস্টমাইজেশন করছি, সেইসব র-ম্যাটারিয়ালের আমদানি মূল্য যদি কম হয় তাহলে এর সবটাই আমাদের কস্টিংয়ের উপর ইফেক্ট করে। আমি যদি মিনিমাম ব্রেক ইভেন-এ গাড়ি ছাড়ি তাহলে আমার কাস্টমারকে সহযোগিতার জন্য আমি যখন ডিউটি বেনিফিট পাব না, তখন বেশি দামে আমাকে গাড়ি বিক্রি করতে হচ্ছে। আর এখানে যদি আমি কাঁচামাল এনে গাড়ি বানাই, সেখানে যদি ডিউটি ফ্রি পাই তাহলে গাড়ির উৎপাদন খরচে সুবিধা পাচ্ছি। কম খরচে উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে আর যেহেতু আমরা লোকালি বানাচ্ছি সেহেতু এগুলো হবে মানসম্পন্ন।

আমরা নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে মাহিন্দ্রার যে ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্ট করেছি সেখানে ইতিমধ্যে এসেম্বলিংয়ের কাজ শুরু হয়েছে। এখানে বানানো গাড়ি আমরা বাজারজাতও শুরু করেছি। ক্রেতাদের মধ্যে ভালো রেসপন্সও আমরা লক্ষ করছি। ক্রেতারা গাড়িগুলো পছন্দ করছেন। সারা বাংলাদেশে এই গাড়িগুলো আমরা বাজারজাত করছি। এসব গাড়ি ‘ওয়ান অব দ্যা বেস্ট কোয়ালিটিফুল ভেহিকল ইন দিস কান্ট্রি’।

একটা কমার্শিয়াল গাড়ি উৎপাদনের সময় কয়েকটা বিষয়ে লক্ষ রাখতে হয়। শুরুতেই আমাদের গাড়ির কোয়ালিটি এনশিওর করতে হয়। আর পরের ব্যাপারটা হলো, রিটার্ন অব ইনভেস্টমেন্ট। আসলে এটা হলো কমার্শিয়াল গাড়ি, যদি এটি যাত্রীবাহী গাড়ি হতো তাহলে যাত্রীর লাক্সারির কথা চিন্তা করতে হতো, পরিবারের সিকিউরিটির ব্যাপারটা মাথায় রাখতে হতো। কমার্শিয়াল গাড়িতে দেখতে হয়, এর জিবিডব্লিউ কত, এর নেট প্রিলোড কত, এটি সর্বোচ্চ কতটা মালামাল বহন করতে পারবে এসব ব্যাপার। আমাদের এখানে ওভারলোড করার একটা অভ্যাস রয়েছে, দেড় টনের গাড়িতে দুই-আড়াই টন ওজনের মালামাল নেয়া হয়। সে ওভার লোড নিতে পারবে কি না, একটা গাড়ি প্রতিদিন কত কিলোমিটার চলবে, একদিনে কত আয় করতে পারবে সেটাও আমাদের মাথায় কাজ করে। বিক্রির ক্ষেত্রে আমরা আমাদের গাড়ি ৩-৪ বছরের মেয়াদী লোনেও বিক্রি করছি। এমন কি দুই বছরের জন্য বিনা সুদেও বিক্রি করছি। যাতে করে ক্রেতারা সর্বোচ্চ ডাউন পেমেন্টে একটা গাড়ি কিনতে পারে। তার পর তিন চার বছরের মধ্যে লোন পরিশোধ করবে। এইসব ফ্যাক্টর আসলে আমাদের খেয়াল রাখতে হয়।

র‌্যাংগস গ্রুপ দীর্ঘদিন ব্যবসা করে আসছে। র‌্যাংগস মটরস নিয়ে আমাদের স্বপ্ন ও ভিশন রয়েছে। আর তা হলো, ভিশন টুয়েন্টি টুয়েন্টি। সে লক্ষ্য সামনে নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের এখন একটাই চাওয়া যেন প্রতিবছর দশ হাজারের কাছাকাছি দেড় টনের নিচের গাড়িগুলো রিটেইল করতে পারি। এটা মাহিন্দ্রার কথা বলছি, আইসার তো আসছে সামনে।

সারা দেশে আমাদের নিজস্ব শো রুমের পাশাপাশি ডিলার রয়েছে যাদের মাধ্যমে আমরা গাড়ি বিক্রি করছি। ছোট ছোট সার্ভিস কাউন্টার আছে। সারা দেশে আমাদের নিজস্ব ওয়ার্কশপ আছে।

চার-পাঁচ বছর ধরে যে হারে আমরা এগোচ্ছি, তার চেয়ে দ্বিগুণ হারে যদি আমরা আমাদের সার্ভিস নেটওয়ার্কটাকে উন্নত না করি, তাহলে আমার কাস্টমার সার্ভিস পাবে না। আর তারা যদি সার্ভিস না পায় তাহলে কমার্শিয়াল গাড়ির ব্যবসার প্রসার হবে না। এখন আমরা ভাবছি, সারা দেশের প্রতিটা কর্ণারে আমরা ওয়ার্কশপ স্থাপন করব। এই বছর আমরা ৭২ টা ওয়ার্কশপ প্রতিষ্ঠা করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এর মধ্যে কাজও শুরু হয়ে গেছে, এক দেড় মাসের মধ্যে এই ওয়ার্কশপগুলো কাজ শুরু করবে। দেশের যেখানে আমাদের শো-রুম রয়েছে সেখানে আমরা থ্রি-এস সেবা চালু করবো। যেখানে গাড়ি বিক্রি হবে, পার্টস্ও পাওয়া যাবে, একইসাথে ওয়ার্কশপের মাধ্যমে সার্ভিসিংয়ের সেবা দেয়া সম্ভব হবে। আমরা চাই সারা দেশে আমাদের সার্ভিস ছড়িয়ে দিতে। গ্রামের যেখানে আমরা শো-রুম দিতে পারব না সেখানে আমরা ছোট আকারের এক্সটেনশন কাউন্টার দিব। আমরা নিজেরাই ডাইরেক্ট সেলিং এজেন্ট দিব। যদি আমি ওয়ার্কশপ না দিতে পারি তাহলে আমি স্যাটেলাইট ওয়ার্কশপ খুলব। যেখানে আমি তাও পারব না সেখানে আমরা মোবাইল সার্ভিস প্রোভাইড করব। যেখানে মোটর সাইকেলে করে আমাদের মেকানিক কাস্টমারের বাসায় গিয়ে সেবা দিয়ে আসবেন। এমনি সব পরিকল্পনার মাধ্যমে আমরা এগিয়ে যাওয়ার চিন্তা করছি।

দিলীপ ব্যানার্জী
চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (সিইও), র‌্যাংগস মটরস লিমিটেড

আজকের বাজার:এলকে/সালি/এলকে ১৫ নভেম্বর ২০১৭