শ্রমজীবীদের নেই করোনা ভীতি, সংক্রমণও কম

ভাসমান,বস্তিবাসী কিংবা শ্রমজীবী মানুষের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার তেমন কোনো সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা কত তার কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও ধারণা করা হচ্ছে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকায় তারা খুব একটা এ মহামারিতে আক্রান্ত হচ্ছে না। হয়তো এ কারণেই শ্রমজীবীদের মধ্যে নেই করোনা আতঙ্ক।
নিম্নবিত্ত মানুষরা ঘনবসতিপূর্ণ স্থানে থাকায় সেখানে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু এরকম কোনো সংবাদও পাওয়া যায়নি।

তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, পরীক্ষা না করার কারণে তাদের মধ্যে আক্রান্তের হার নির্ণয় করা যাচ্ছে না। কারো কারো মতে এ শ্রেণির মানুষ শারীরিক পরিশ্রম বেশি করে। এছাড়া রোদ, বাতাস ও মাটির সংস্পর্শে থাকায় এবং করোনা নিয়ে আতঙ্কে না থাকার কারণে তাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। তবে কেন নিম্নবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের হার কম কিংবা কতটা এ বিষয়টি নিয়ে গবেষণার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

পরিবহন শ্রমিক, বস্তিবাসী, গৃহকর্মী, রিকশা চালক কিংবা হকারদের মত কায়িক পরিশ্রমী মানুষের জীবনাচার পর্যবেক্ষণ করে এবং তাদের সাথে কথা বলে দেখা যায়, করোনা মোকাবিলায় যেসব সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হয়, তার বেশিরভাগই তারা অনুসরণ করেন না। নিয়মিত হাত ধোয়া কিংবা মাস্ক ব্যবহারের মত বিষয়গুলো তাদের মধ্যে অনুপস্থিত।

কুড়িগ্রামের বাসিন্দা সোলায়মান রাজধানীতে রিকশা চালাচ্ছেন গত ৮ বছর ধরে। থাকেন যাত্রাবাড়ির ধলপুরের একটি বস্তিতে। অন্য সময় মাস্ক ব্যবহার না করলেও রিকশায় যাত্রী নেয়ার সময় মাস্ক ব্যবহার করেন। তবে সেটিও বেশ ময়লা হয়ে গেছে। ময়লা মাস্ক ব্যবহার করছেন কেন- জানতে চাইলে বলেন, মাস্ক পরে কি হবে। আমারা গরীব মানুষ। আমাদের কিছুই হবে না। শুধু যাত্রীদের জন্য মাস্ক ব্যবহার করি। তা না হলে যাত্রীরা রিকশায় উঠতে আপত্তি করে।

তিনি জানান, তাদের বস্তিতে কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়নি। সবাই ভালো আছে।

মিরপুর ৮ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার কাশেম মোল্লা জানান, তার ওয়ার্ডে বালুর মাঠের বস্তি, ঝিলপাড় বস্তি ও চিড়িয়াখানা বস্তি আছে। তিনি নিয়মিত তাদের খোঁজ-খবর রাখছেন। সেখানে কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়নি বলে জানান তিনি।

রাজধানীর দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন ধলপুর সিটি পল্লীর বস্তিটি বেশ পুরনো এবং বড়। এই ওয়ার্ডের কমিশনার বাদল সর্দার জানান, সিটি পল্লী বস্তি ছাড়াও তার ওয়ার্ডে বেশ কিছু এলাকা ঘনবসতিপুর্ণ। এখানে অনেক নিম্নবিত্ত খেটে খাওয়া মানুষের বসবাস। এসব মানুষের কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়নি বলে জানান তিনি।

সম্প্রতি আগুনে পুড়ে যাওয়া কমলাপুর টিটিপাড়া বস্তিতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেখানেও কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়নি।এই বস্তির সবাই পরিচ্ছন্নতা কর্মী। এখানকার বাসিন্দা প্রকাশ জানান, তাদেরকে ময়লা নিয়ে কাজ করতে হয়। সিটি কর্পোরেশন থেকে তাদেরকে মাস্ক ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হলেও অধিকাংশই তা মানেন না।

তিনি আরো বলেন, আমরা এক কক্ষে ৫-৭ জন করে থাকি। ইচ্ছে করলেও ঘনবসতিপূর্ণ এই বস্তিতে আমাদের পক্ষে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করা সম্ভব না। তারপরও এখানে কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়নি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা.লেনিন চৌধুরী বলেন, শারীরিক পরিশ্রম, রোদ, বাতাস ও মাটির সংস্পর্শে থাকলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। আবার যারা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্থানে বেশি থাকেন, ফ্রিজে রাখা সংরক্ষিত খাবার খান, শারীরিক শ্রম কম করেন, তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। শুধু কোভিড-১৯ নয়, সব ভাইরাসের জন্যই এসব শর্ত প্রযোজ্য। হয়তো এসব কারণেই শ্রমজীবী মানুষের করোনায় আক্রান্তের হার কম।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে সচেতনতা ও সামর্থের অভাবে নিম্ন আয়ের মানুষ জ্বর-সর্দি হলে খুব একটা পাত্তা দেননা। তাই হয়তো তাদের মধ্যে আক্রান্তের বিষয়ে জানা যাচ্ছে না। আবার করোানায় আক্রান্তের ৮০ শতাংশের কোন উপসর্গ থাকে না। অনেকে আবার এমনিতেই সুস্থ হয়ে যাচ্ছে। তাদের মতে এ বিষয়ে গবেষণা না করে নির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে আসা যাবে না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও কোভিড-১৯ বিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা.নজরুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, কেন শ্র্রমজীবী বা নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে করোনা সংক্রমণের হার কম, তা আমরা জানি না। এজন্য গবেষণার প্রয়োজন। তাদের কি ইমিউনিটি আছে, তা জানতে গবেষণার দরকার।

তিনি বলেন, তাদের সামাজিক-আর্থিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থানের কারণে এরইমধ্যে তারা অনেক ধরনের ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়েছেন। হয়তো করোনা রিলেটেড কোনো ভাইরাস দ্বারা তারা আগেই আক্রান্ত হয়েছেন। তাই এখন করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে না। এই ধারণা তার একান্তই ব্যাক্তিগত বলে মন্তব্য করেন তিনি।