শেষ দিন। শেষ সেশন। বাকি ছিল আরো ১৭ ওভার। ১০৭ রানের লিড। এক ঘণ্টারও বাকি ৫ দিনের খেলার শেষটায়। কিন্তু প্রথম ইনিংসে গ্ল্যাডিয়েটরের মতো লড়ে বড় কিছু টাইগাররা করার পর তারো চেয়ে বিশালতা দেখিয়েছে লঙ্কান সিংহদের প্রথম ইনিংস। তারপর? চতুর্থ দিনের শেষ বিকেলে গিলোটিনের নিচে শরীর ঠেলে দেওয়ার সখ বুঝি হয়েছিল স্বাগতিকদের। ৮১ রানে নেই ৩ উইকেট। 'টাইমলেস টেস্ট' খেলার মতো উইকেটে এই অবস্থা! আতঙ্কে বুক কাঁপে কোটি কোটি বাঙালী ক্রিকেটপ্রেমীর। কিন্তু আহত বাঘ যে আরো কতো ভয়ঙ্কর হতে পারে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে সেটি হাড়ে হাড়ে দেখিয়ে দিল। ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধের বুহ্য তৈরি করে প্রকাণ্ড গর্জনে ঝাঁপিয়ে পড়ল সিংহেরই ওপর। তাতে এই টেস্টে দুহাত ভরে পাওয়া মুমিনুল হকের এক টেস্টে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে দুই সেঞ্চুরির ইতিহাস দেখল সৌভাগ্যের এই নগর। তাতে হারার শঙ্কা মুক্তি। শেষে যখন সত্যিকারের 'নেতা' মাহমুদউল্লাহ আবার বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে, তখন অনেক চেষ্টাতেও কিছু হচ্ছে না দেখে একরকম হারই মেনে নেওয়া। নাহ! হলো না! লঙ্কানরা ভাবে, তাদের স্বাধীনতা দিবসের উৎসবের দিনে (৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮) এইভাবে বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে গেল বাংলাদেশ? এমন ম্যাচে শেষদিনের মহা-আতঙ্ক বীর বিক্রমে জয় করে শ্রীলঙ্কানদের ড্র মেনে নিতে বাধ্য করা তো স্বাগতিকদের জন্য বিজয়েরই সমান!
২ ম্যাচের সিরিজ। রোববার সেখানে জয় তো মাহমুদউল্লাহরও। এটা তার সত্যিকারের জন্মদিন না পাসপোর্টের সে বিচার করতে আসবে না মহাকাল। ওখানে লেখা থাকবে, ভাষা আন্দোলনের মাসে জন্ম নেওয়া পুরুষটির দৃঢ়চিত্তে সামনে থেকে দেওয়া নেতৃত্ব বিশেষ দিনটাতে তাকেও করলো পুরস্কৃত, সারাজীবন মনে রাখার জন্য। দৈবচক্রে সহ-অধিনায়ক হয়েও প্রথমবারের মতো বাংলাদেশকে কোনো টেস্টে নেতৃত্ব দিলেন। 'টেস্ট' নামের ৫ দিনের অভিজাত-মর্যাদার এবং যে কোনো সময় খেলার মোড় ঘোরার লড়াইয়ের শেষ দিনে ক্রিকেট পাগল এই জাতি যে তাকিয়ে ছিল সাগরিকার এই স্টেডিয়ামের দিকে। দুরু দুরু বুকে। সেখানে হারতে হলে কি অবিচারই না হতো! হয়নি। এবং ক্যাপ্টেন মাহমুদউল্লাহ হার না মানেই মাঠ দেখে বেরিয়েছেন 'জন্মদিনের উপহার' ড্র নিয়ে। আর ফেরার নতুন গল্প লিখে সেই ম্যাচে সবচেয়ে বড় নায়ক হয়ে উঠে ম্যান অব দ্য ম্যাচ মুমিনুল হক। দারুণ স্বস্তি নিয়ে এবার টাইগারদের ঢাকায় ফেরার পালা।
আগের দিন টাইগারদের দ্বিতীয় ইনিংসের তৃতীয় উইকেটটা (মুশফিকুর রহীম) পড়েছিল দিনের শেষ ওভারের শেষ বলের আগেরটিতে। তাতেই অনেকটা আতঙ্ক চেপে ধরেছিল স্বাগতিক ভক্ত-সমর্থকদের। তৃতীয় দিনে আরো তিনটি সেশন। শীর্ষ তিনকে হারিয়ে শেষ দিনটায় না হয় সর্বনাশ। প্রথম ইনিংসে গোল্ডেন ডাক মারা লিটন কুমার দাসকে নিয়ে ব্যক্তিগত ১৮ রানে এদিন নামলেন ওই ইনিংসেই ১৭৬ রানের মহাকাব্যিক ইনিংস খেলা মুমিনুল। ছোটখাটো মানুষের বিশাল মস্তিস্ক এবং হৃদয় নড়বড়ে দেখানো লিটনকেও দিয়েছে সাহস। ৩ উইকেটে ১৮১ রানে শুরু। তখনো পিছিয়ে ১১৩ রানে। বাংলাদেশের ৫১৩ এর জবাবে ৯ উইকেটে ৭১৩ রান করে নিজেদের প্রথমটি ঘোষণা করেছিল লঙ্কানরা। প্রতিপক্ষের ড্র’র প্রস্তাব মেনে নেওয়ার সময় টাইগাররা দ্বিতীয় ইনিংসে ৫ উইকেটে ৩০৭ রানে। ১০৭ রানের লিড। মাহমুদউল্লাহ ২৮ আর মোসাদ্দেক হোসেন ৮ রানে অপরাজিত।
কিন্তু বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। বাংলাদেশের এখন এমন কঠিন পরিস্থিতি সামলানোর বিশ্বাস আছে। সাহস তো এখন পায়ে পায়েই হাঁটে। সমুদ্রের বিশালতার শহর কক্সবাজার থেকে উঠে আসা মুমিনুলের সেই প্রবল সাহস সংক্রমিত হয় লিটনেরও মাঝে। ৫২, ২৪ ও ৫ রানের প্রথম তিনটি জুটির পর তাই এই দুইয়ের মাঝে চতুর্থ উইকেটে দাঁড়িয়ে যায় ১৮০ রানের পার্টনারশিপ। যেখানে আগ্রাসনের সাথে প্রতিপক্ষকে সমীহ, নিজেদের মধ্যেই সমান গতিতে ছোটা। মুমিনুল ওই জুটির ৮৭ রানের মালিক, লিটনের সেখানে ৮৬। তারাই তো প্রায় দুই সেশন খেলে দিলেন। শেষ দিনেও চমৎকার ব্যাটিং উইকেট। যেখানে তামিম ইকবালকে টপকে এক টেস্টে সবচেয়ে বেশি রানের মালিক এখন মুমিনুল। ষষ্ঠ সেঞ্চুরি। ১০৫ রান করে যখন ফিরেছেন তখন টাইগাররা অনেক নিরাপদ অবস্থানে। ২৬ টেস্টে মুমিনুলের ৬ সেঞ্চুরি! তার পাঁচটি আবার এই মাঠে।
২৩ বছরের লিটনের ভাগ্যটা শেষে খুলতে শুরু করেছে। সপ্তম টেস্টে এসে প্রথম সেঞ্চুরি দরজায় দাঁড়ালেন। কিন্তু ছক্কা মেরে তিন অংকের ম্যাজিক ফিগারে পৌঁছানোর দুরন্ত সাহসেই হৃদয় ভাঙে। বর্ষীয়ান রঙ্গনা হেরাথ ঝাঁপিয়ে যেভাবে ক্যাচটা নিয়েছেন, সেটাও বড় কৃতিত্বের।
লাঞ্চে গিয়েছিল বাংলাদেশ লিডের সাথে ১৩ রানের ব্যবধান রেখে। মুমিনুলের ব্যাটেই সিঙ্গেল থেকে ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যে লিড আসে। প্রাথমিক পরিকল্পনায় সফল। ধৈর্য্য ও জুটি গড়ার কাজটা হয়ে গেছে। উইকেটে মাথা খুড়ে মরা লঙ্কান বোলারদের শরীরী ভাষাতেও ফুটে ওঠে হতাশা।
৫ উইকেট হারিয়ে ৮১ রানের লিড নিয়ে স্বাগতিকরা যখন চা বিরতিতে যায় বাংলাদেশ ভারপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেনেরই নেতৃত্বে। তখন তিনি ১২ তে, কোনো রান না তুলে মোসাদ্দেক হোসেন সাথে। ফিরে আসার পরও নানা পরিকল্পনায় ব্যর্থ হয়ে লঙ্কানরা বুঝে যান, প্রথম ইনিংসে ‘গ্ল্যাডিয়েটর’ হয়ে ওঠা মাহমুদউল্লাহর চীনের প্রাচীর ও সতীর্থকে আগলে রাখার প্রতিরোধব্যবস্থা ভাঙা সম্ভব হলেও হতে পারে কোনোভাবে কিন্তু ম্যাচে জেতার সময় নেই আর।
এরপর মাহমুদউল্লাহ সংবাদ সম্মেলনে আসেন নায়ক-বীর, নানা উপাধীতে যাকে অলঙ্কৃত করা যায় সেই মুমিনুলকে নিয়ে। সেখানে কি নির্ভার সেনানায়ক ও তার প্রধান সমরাস্ত্র। তবে বুঝে নেওয়া যায় উচ্চারণে, এই ড্র কোনো অংশে জয়ের কম নয়। এরপর জনপ্রিয় ও অভিজ্ঞ ক্রীড়া সাহিত্যিক সাইদুজ্জামানের উদ্যোগে মাঠে যখন দুই বীর কেক কাটেন, তখন সেই ব্যাপারটা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আতঙ্ক জয় করে আরো পরিণত হয়ে ওঠার যাত্রাপথের এই বাংলাদেশ ঢাকায় আরো বড় লক্ষ্য নিয়ে ঝাঁপানোর ছক যে কষে রেখেছে, তা তো মাত্র শেষ হওয়া দুই ম্যাচ সিরিজের প্রথম খেলাটিতে টাইগারদের গতিপথটা বলেই দিচ্ছে ঘোষণা করার মতো করে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর :
বাংলাদেশ প্রথম ইনিংস : ৫১৩ (১২৯.৫) (তামিম ৫২, ইমরুল ৪০, মুমিনুল ১৭৬, মুশফিকুর ৯২, লিটন ০, মাহমুদউল্লাহ ৮৩*, মোসাদ্দেক ৮, মিরাজ ২০, সানজামুল ২৪, তাইজুল ১, মোস্তাফিজ ৮; লাকমাল ৩/৬৮, কুমারা ০/৭৯, দিলরুয়ান পেরেরা ১/১১২, হেরাথ ৩/১৫০, সান্দাকান ২/৯২, ধনঞ্জয়া ডি সিলভা ০/১২)।
শ্রীলঙ্কা প্রথম ইনিংস : ৭১৩/৯ (১৯৯.৩ ওভার) (করুনারতেœ ০, মেন্ডিস ১৯৬, ধনঞ্জয়া ডি সিলভা ১৭৩, রোশেন ১০৯, চান্দিমাল ৮৭, ডিকভেলা ৬২, দিলরুয়ান ৩২, হেরাথ ২৪, লাকমাল ৯, লাহিরু ২*; মোস্তাফিজুর ১/১১৩, সানজামুল ১/১৫৩, মিরাজ ৩/১৭৪, তাইজুল ৪/২১৯, মোসাদ্দেক ০/২৪, মুমিনুল ০/৬, মাহমুদউল্লাহ ০/৭)।
বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংস : ৩০৭/৫ (১০০ ওভার) (তামিম ৪১, কায়েস ১৯, মুমিনুল ১০৫, মুশফিক ২, লিটন ৯৪, মাহমুদউল্লাহ ২৮*, মোসাদ্দেক ৮*; হেরাথ ২/৮০, লাকমাল ০/২৫, ধনঞ্জয়া ডি সিলভা ১/৪১, দিলরুয়ান পেরেরা ১/৬৪, সান্দাকান ১/৬৪, লাহিরু ০/১৬, কুশল ০/২)।
ফলাফল : ড্র।
ম্যান অব দ্য ম্যাচ : মুমিনুল হক।
আজকের বাজার : সালি / ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮