শ্রেণিকক্ষ শতভাগ মাল্টিমিডিয়া হতে হবে

শিক্ষা ভাবনা

প্রফেসর ড. রফিকুল ইসলাম শরীফ
বর্তমানে বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষার শুরুটা কেমন ছিলো? একবার ফিরে তাকানো যাক। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লাইড ফিজিক্স অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিকস বিভাগে ১৯৬৭ সালে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করি। এরপর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ-বৃত্তি দেন। এই বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাজ্যের ডারহাম ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি শেষ করি। এরপর ইংল্যান্ডের লিডস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইসিটির উপর উচ্চতর গবেষণা করে ১৯৮৫ সালে দেশে ফিরে আসি। দেশে এসে চিন্তা করলাম, বিদেশে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা ১২-১৪ বছর বয়সে প্রোগ্রামিংয়ে অনেক দক্ষ। তাদের এই দক্ষতা আমাকে ভীষণভাবে মুগ্ধ করেছে। এরপরই আমি দেশে আইসিটি শিক্ষার পরিবর্তন আনতে চেষ্টা করি। ১৯৮৯ সালে আমিই প্রথম বাংলাদেশে কম্পিউটার শিক্ষার কাজ শুরু করি। এর জন্য প্রতিষ্ঠিত করি ‘মাইক্রোল্যান্ড কম্পিউটার অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইনস্টিটিউট’। এখান থেকেই লন্ডন বিশ^বিদ্যালয়ের ‘ও’ লেভেল কম্পিউটার সাইন্স প্রদান করি। পরে ‘এ’ লেভেলও চালু করি। তখন শুধু বুয়েটে কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগ শুরু হয়েছিলো। লন্ডন বিশ^বিদ্যালয়ের ডিপ্লোমা এবং বিএসসি কম্পিউটার সায়েন্স প্রথম বাংলাদেশে চালু করি মাইক্রোল্যান্ডের মাধ্যমে, ১৯৯৬ সালে।

১৯৯২-৯৩ সালে এসএসসি এবং এইচএসসিতে কম্পিউটার সায়েন্স আমি প্রবর্তন করি। তখন থেকেই এসএসসি এবং এইচএসসিতে কম্পিউটার কোর্সটি চালু করা হয়। আর সেখান থেকেই মূলত এদেশে আইসিটি শিক্ষার প্রচলন শুরু হয়। এরপর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে, আইসিটি শিক্ষা আরও ব্যাপকভাবে আরম্ভ হয়। বাংলাদেশে কম্পিউটার সায়েন্সের যে আলোড়ন, বলতে পারেন সেটা আমিই করেছি। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রথম আন্তর্জাতিক গ্রোগ্রামিং কন্টেস্টে অংশগ্রহণ করে আমার মাইক্রোল্যান্ডের শিক্ষার্থীরা। আমি চেষ্টা করেছি, কিছু দক্ষ জনশক্তি তৈরি করার জন্য। এ সময় যারা দক্ষ হয়েছে তারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। মূলত ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের যে অবদান, এটিই আইসিটির উপর প্রথম পদক্ষেপ। আর আমি ছিলাম পিছনে।

আইসিটি শিক্ষার জন্য দেশে এখন অনেক প্রতিষ্ঠান। যে পরিমাণ প্রতিষ্ঠান, সে পরিমাণ দক্ষ জনশক্তি কি আমরা পাচ্ছি? অথবা দক্ষ জনশক্তির অভাব রয়েছে কিনা তা আলোচনা করা যাক। আমরা দেখছি,দেশে আইসিটি শিক্ষা ব্যবস্থায় একটা বড় পরিবর্তন এসেছে। অনেক প্রতিষ্ঠানও হয়েছে। সরকারি বেসরকারি অনেক বিশ^বিদ্যালয় আছে এখন । তবে সত্যিকারের প্রোগ্রামার এবং সিস্টেম অ্যানালিস্টের সংখ্যা বাংলাদেশে এখনো অনেক কম। আর দক্ষ জনশক্তির এখনো অনেক অভাব রয়েছে।

আইসিটিতে আমাদের আরও দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা দরকার । দক্ষ জনশক্তি বাড়াতে বা তৈরি করতে আমাদের সরকার যেমন পদক্ষেপ নিয়েছে পাশাপাশি বিভিন্ন পাবলিক সেক্টর ও অরগানাইজেশনকেও এগিয়ে আসতে হবে। একই সঙ্গে বিশে^র নামি দামি প্রোগ্রামার যারা আছেন, তাদের দেশে এনে তরুণ প্রোগ্রামারদের উদ্বুদ্ধ করা একান্ত প্রয়োজন। এ বিষয়ে আমি ইতিপূর্বে একটি আর্টিকেল লিখেছি। যার শিরোনাম ছিল ‘দেশেই তৈরি হোক প্রযুক্তি’।

ইতিমধ্যেই দেশে অনেক আইসিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বেশি প্রতিষ্ঠান কি দক্ষ জনশক্তি তৈরির ক্ষেত্রে অন্তরায়? এ বিষয়ে বলব, ১৯৯২-৯৪ সালে কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগ শুধু ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ও বুয়েটে ছিল। ঢাবিতে ২০টি আর বুয়েটে ৪০টি আসন ছিল। কিন্তু এই ৬০টি আসনের জন্য লড়াই করতো প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থী। এতে করে মেধাবী থেকেও যারা বেশি মেধাবী তারাই শুধু পড়ার সুযোগ পেত। এই জন্য দক্ষ জনশক্তি তখন তৈরি হতো বেশি। কিন্তু এখন সরকারি বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান হওয়ার ফলে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরাও কম্পিউটার সায়েন্স পড়ছে। ফলাফল বছরে ১০ হাজার শিক্ষার্থী বের হলেও দক্ষ জনশক্তি আমরা পাচ্ছি মাত্র ৫০০। আমাদের এখানে কোয়ালিটি এডুকেশন দিলেও আমরা মেধবী পাচ্ছিনা। কারণ বছরে যে ৫০০ দক্ষ জনশক্তি বের হচ্ছে এগুলোও বিদেশি প্রতিষ্ঠান কিনে নিচ্ছে।

এসব দক্ষ জনশক্তি যে আমরা হারাচ্ছি, তার পিছনে কি শুধুই অর্থনৈতিক কারণ? আসলে কম্পিউটার সায়েন্সের যে দক্ষ জনশক্তি আমরা হারাচ্ছি তার পিছনে মূলত দুটি কারণ প্রধানভাবে কাজ করছে। প্রথমত সুযোগ সুবিধার অভাব। দ্বিতীয়ত, সম্মানীর কারণে। আমরা এখানে মেধাকে উৎসাহিত করার জন্য সুযোগ সুবিধা দিচ্ছিনা। একইসঙ্গে বলব ইনসেনটিভও দিচ্ছিনা। অথচ এই সুযোগগুলোই দিচ্ছে বিদেশিরা। ফলে আমরা দক্ষ জনশক্তি হারাচ্ছি ।

অন্য একটি বিষয়ে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই। বর্তমান সময়ে প্রশ্ন ফাঁস একটি আলোচিত বিষয়। আমি প্রতি বছরই শুনছি প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন পর্যন্ত ফাঁস হচ্ছে। এটি সত্যিকার অর্থেই দুঃখজনক। এই প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসতে হলে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের আরও দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। এটা বন্ধ করা না গেলে দেশের উন্নয়নের পথও বাঁধা পাবে। আর প্রকৃত মেধাবীরা দেশে থাকতে অনীহা দেখাবে। কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি প্রশ্ন ফাঁস রোধে অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে।

এছাড়া মেধার বিকাশ ঘটাতে আরও যা করা দরকার বলে মনে করি তা হলো, প্রাইমারি স্কুল এবং সেকেন্ডারি স্কুল থেকে যদি ছেলে মেয়েদের ভালোভাবে শেখানো হয়। মেধার সত্যিকার বিকাশ যদি ঘটানো যায়, ভবিষ্যতে সে কী করবে তা যদি সে ঠিক করতে পারে, তাহলে সে দাঁড়াতে শিখবে। কলেজে গিয়ে সে হাঁটতে শিখবে। বিশ^বিদ্যায়ে সে নিজের চেষ্টায় দৌঁড়তে পারবে। এটাই হলো শিক্ষার নিয়ম। কিন্তু প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারিতে যদি সে না দাঁড়াতে পারে অর্থাৎ কোনও গাছের গোড়া যদি শক্ত না হয়, তাহলে ডালপালা, পাতা বা ফল-ফুল পরিপক্ক হবেনা। তাই প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারির শিক্ষাকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এই জায়গায় যদি আমরা কঠোর হতে পারি তবে মেধা বিকাশে আর কোনও সমস্যা থাকবেনা।

স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরে এসে শিক্ষা ব্যবস্থার বর্তমান অবস্থা কোথায় এসে ঠেকেছে। স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর পরে জনস্খ্যংা অনেক বেড়ে গেছে। বেড়েছে মিস ম্যানেজমেন্টও। অনেক সময় সরকার যেভাবে চালাতে চায়, সেভাবে চালাতে পারছেনা। বিভিন্ন জায়গায় মানহীন লোকজন গুরুত্বপূর্ণ সিটে বসে আছেন। এই মানুষগুলো নিজেদের ফোকাস করতেই বেশি ব্যস্ত। সঠিক মানুষকে তারা ফোকাস করতে চায়না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে অনেক চিন্তা করে রেখেছেন। এসব উনার একার পক্ষে বাস্তবে প্রয়োগ করা কঠিন। যদি আমাদের দেশপ্রেমিকের সংখ্যা না বাড়ে তাহলে তা বাস্তবায়ন কঠিন হবে। শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে সঠিক ব্যক্তিকে মূল্যায়ন করতে হবে। সকলে মিলে দেশকে ভালোবাসার মাধ্যমেই শিক্ষা ব্যবস্থার আরও সমৃদ্ধি সম্ভব।

তবে ইতিমধ্যে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করা হয়েছে। তারপরও এই জায়গাকে আরও সমৃদ্ধ করা দরকার বলে মনে করি। শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন সত্যিকার অর্থেই সময়ের দাবি। আধুনিকায়ন হচ্ছেও। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রে এখনো শতভাগ আধুনিক আমরা হতে পারিনি। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ সুবিধা থাকার পরও শিক্ষা ব্যবস্থায় পুরোপুরি মাল্টিমিডিয়া করা সম্ভব হয়নি। শিক্ষা ক্ষেত্রে শতভাগ মাল্টিমিডিয়া পদ্ধতি চালু করতে হবে। তবেই আমরা আরও সমৃদ্ধ হবো।

প্রফেসর ড. রফিকুল ইসলাম শরীফ
উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ (ইউডা)।