সাইবার অপরাধ ফেসবুকে নারী নিগ্রহ ও করণীয়

বর্তমান বিশ্বে সামাজিক যোগাযোগের সবচাইতে জনপ্রিয় মাধ্যম হচ্ছে ফেসবুক। বিপুল এই জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে আমেরিকায় একটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে যার নাম “দ্যা সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ‘।যদিও আমেরিকায় বক্স অফিস হিট এই ছবিটি তথাপি জনপ্রিয় এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যিনি প্রতিষ্ঠাতা তার জন্য সুখকর নয় ।কারন তাতে মার্ক জুকারবার্গের ইমেজে কিছুটা কালিমা লেপন করা হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। এবার মূল প্রসঙ্গে, ফেসবুক জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হলেও তা কখনো হুমকিস্বরূপও বটে।

যার কারনে ঘটছে নারী নিগ্রহের ঘটনা। প্রথমত ভূয়া আইডির পাল্লায় পড়ে প্রেমের ফাঁদে পড়ছে বিভিন্ন বয়সের নারী। এদের মধ্যে কিশোরী ও তরুণীর সংখ্যাই বেশী। যারা না বুঝেই কিংবা আবেগের বর্শবর্তী হয়ে গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে সর্বস্ব খোঁয়াচ্ছে। দেশে সম্প্রতি পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে ৭০ শতাংশ নারী ফেইসবুক ব্যবহারকারী যাদের বয়স ২৫ বছরের নীচে,তারাই এসব সাইবার ক্রাইমের শিকার।

এদের ভেতর শিক্ষার্থী,উচ্চবিত্ত এবং চাকরিজীবী নারীও আছে।তাছাড়া গ্রামে, পাড়া মহল্লাতে ফেসবুক ব্যবহারকারী নারীর সংখ্যাও কম নয়। ভূয়া আইডি খুলে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে নারীদের সাথে প্রেমের সম্পর্ক তৈরী করা এরপর বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে অভিনব কায়দায় নারীদের জব্দ করছে এসব ফেসবুক আইডি প্রতারক। নারীদের সাথে অহরহ কথোপকথন, মিথ্যা সম্পর্কের জাল বিছিয়ে দেখা করা,অশ্লীল প্রস্তাব দেয়া এছাড়া পোষ্টে নানা প্রকার অপ্রীতিকর মতামত ব্যক্ত করে মানসিকভাবে বিরক্তির উদ্রেক ঘটাচ্ছে। কখনোবা ম্যাসেঞ্জারে মধ্যরাতে ছুঁড়ে দিচ্ছে আপত্তিকর বার্তা কিংবা অশ্লীল ছবি। যেসব নারীরা এসব ভূয়া প্রেমের জালে জড়িয়ে পড়ে তারা আবেগের বর্শবর্তী হয়ে প্রতারক প্রেমিকের প্রস্তাবে সামিল হয়।

অতঃপর তাদের চাহিদা মোতাবেক অশ্লীল ছবি অথবা ভিডিও ধারণ করতে তারাই সহায়ক হয়। শেষতোক ঐ নারীদের সর্বনাশ ঘটে। সুযোগমতো সেসব ভিডিও লিক করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়া হবে বলে মোটা অংকের টাকা চেয়ে ব্ল্যাকমেইল করা হয় ঐ নারীদের। যারা এসব প্রতারকদের প্রেমের প্রস্তাবে রাজী হননা তাদেরও নিস্তার নেই।তাদের ফেসবুক আইডি হ্যাক করে প্রয়োজনীয় ছবি ও তথ্য মুছে দিচ্ছে। এছাড়া ছবিগুলো সংগ্রহ করে অশ্লীল ছবি এডিটিং এ জুড়ে দিয়ে পর্নোসাইটগুলোতেও দিয়ে দিচ্ছে এইসব ভয়ংকর ভূয়া আইডি ধারনকারী প্রতারক। শুধু তাই নয়, ব্যক্তিগত মোবাইল নাম্বার সেসব সাইটে দিয়ে একের পর এক কল করে মারাত্মকভাবে অপপ্রচার বা দুর্নাম করছে নারীদের। ফলশ্রুতিতে কারো সংসার ভাঙছে,কারো সামাজিক মর্যাদা ব্যাপক হারে বিপর্যস্ত হচ্ছে।কেউ চাকরীচ্যুত হচ্ছে অথবা লজ্জা অপমানে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। কেউ বা আত্মসম্মান হারিয়ে ভীষনভাবে মানসিক বিপর্যস্ত।অতঃপর মনোচিকিৎসকের দ্বারস্থ হচ্ছে।

তাছাড়া ভূয়া আইডি প্রেমিকের পাল্লায় পড়ে পরকীয়ার ঘটনায় কম নয়।এতে করে দাম্পত্যকলহ বেড়ে যাচ্ছে আংশকাজনক হারে। সাইবার জগতে সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটেগুলোতে নারীদের হয়রানির ঘটনা ক্রমশও বাড়ছে।যা বিটিআরসি(বাংলায় ঃবাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রন কমিশন) গঠিত বাংলাদেশ কম্পিউটার সিকিউরিটি ইন্সিডেন্ট রেসপন্স টিমের(বিডি-সিএসআইআরটি) কাছে জড়ো হওয়া বিপুল সংখ্যকই প্রমাণ। তাদের কাছে গত দেড় বছরে দুই হাজারের মতো অভিযোগ এসেছে।যার প্রায় ৭০ শতাংশ ফেসবুক ও পর্নো ওয়েবসাইটগুলোকে কেন্দ্র করে। উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েরাও সাইবার ক্রাইমের শিকার হচ্ছে আশংকাজনক হারে।কাজেই তাদের বাবা,মাদেরকে অবশ্যই তাদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা জরুরী। অন্যের ফেসবুক পেইজ জনপ্রিয় হয়ে গেলে তাও হ্যাকড করে ব্ল্যাকমেইল করা হচ্ছে।

হ্যাক করার পর হ্যাকডকারী দশ লাখ টাকা বা মোটা অংকের এমাউন্ট দাবী করে উদ্ধার করার আহবান জানায়। উল্লেখ্য বিটিআরসি সাইবার ক্রাইম বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন ইউটিউব ও ভিডিও শেয়ারিং সাইটগুলোর বিরুদ্ধেও বিভিন্ন অভিযোগ আসছে। এক্ষেত্রে সাইটগুলো দ্রুত সরিয়ে ফেলার জন্য অনুরোধ করা হয় তা না হলে সেগুলো বাংলাদেশে না দেখার ব্যবস্থা করা হয়। তা প্রতিরোধের জন্য গতবছর বিডি-সিএসআইআরট সেল গঠন করে এ পর্যন্ত ৩১৭টি ওয়েবসাইট ব্লক করে।যার মধ্যে ২২২টিই পর্নোসাইট। তথাপি এসব ওয়েবসাইট বন্ধ করা গেলেও ফেসবুকের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না এসব নিয়ন্ত্রন সংস্থা। তার কারন হিসেবে তদন্ত করে দেখা যায়, প্রাথমিক অবস্থায় অভিযোগকারীর নিজস্ব ফেইসবুক একাউন্ট থাকলে তার পরিচয় পত্র(ফটো আইডি) ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে পাঠানো হয়।আর যাদের ফেসবুক একাউন্ট নেই তারা থানায় জিডি করার পর তাদের অনুলিপি ফেসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হলেও কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায় না।

তদূপুরি বিটিআরসি কর্তৃক গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে জানা যায় যে,সাইবার ক্রাইমে অভিযোগের ভিত্তিতে সামাজিক,রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বা বিদ্বেষ মূলক সমস্যার সূরাহা হলেও নারীর প্রতি ফেসবুকের মাধ্যমে যৌন হয়রানির বিষয়গুলো তেমন ফলপ্রসূ নয়। তার কারন হিসেবে এভাবে চিহ্নিত করা যায় যে, যেসব ভূয়া একাউন্ট থেকে আপত্তিকর ছবি ও বার্তা ছড়ানো হয় সেগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় ঠিকই কিন্তু পরবর্তীতে আরেকটি একাউন্ট খুলে সেখান থেকে একই কাজ করে হয়রানি করা হয়। অন্তত দুঃখের বিষয় ফেসবুকে যৌন হয়রানির বিষয়টি মারাত্মক সাইবার অপরাধ হলেও বাংলাদেশের আইন কাঠামো এ ব্যাপারে তেমন সক্রিয় নয় ফলশ্রুতিতে ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে চাপ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী,সাইবার অপরাধের বিষয়টি “আইসিটি এক্ট’ এর আওতায় পড়ে।কিন্তু বিটিআরসি চলে টেলিকম আইনে।ফলে বিটিআরসির ডাকে সাড়া দেয়ার যথেষ্ট আইনি বাধ্যবাধকতাও নেই বলে মনে করা হয়। কাজেই নারী ফেসবুক ব্যবহারীরা ফেসবুক ব্যবহারে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন না করলে এখন পর্যন্ত এর কোন স্থায়ী সমাধান নেই।

যদিও কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শির্ক্ষাথী কর্তৃক ফেসবুক নিরাপত্তার জন্য দ্রুত অ্যাপস গঠনের আহবান করছে। সবচেয়ে বড় কারন হিসেবে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চল্লে নারী পুরুষ উভয়ই যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করে চলতে পারে। নারীদের প্রতি বিকৃত মানসিকতা বর্জন করে শ্রদ্ধাশীল হবার জন্য জোর মতবাদ ব্যক্ত করে এই সামাজিক মাধ্যমগুলোতেও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। আইডি হাইজ্যাক কারী ও ভূয়া আইডি ধারনকারীদের সনাক্ত করে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে এক্ষেত্রে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে তৎপর হতে হবে প্রয়োজনে সামাজিক আন্দোলন বাড়িয়ে এ পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। নারী ফেসবুক ব্যবহারকারীরা তাদের গুরুত্বপূর্ন ছবি ও পোষ্টগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত না করে প্রাইভেসি সিষ্টেম করে দিবে, যাতে করে তার বন্ধুরা ছাড়া অন্যকেউ পোষ্টগুলো না পড়ে। অহেতুক অচেনা বন্ধু বৃদ্ধি না করা। অহেতুক ফলোয়ার না হওয়া বা না করা। অহেতুক বিভিন্ন ধরনের গ্রুপে এড না হওয়া। বন্ধুদের তালিকা হালনাগাদ করে অপ্রয়োজনীয় বন্ধুদের থেকে দূরে থাকাই নিরাপদ। কাউকে সন্দেহ হলে তাকে ব্লক করে দেয়াই শ্রেয়।

নিজের ল্যাপটপ বা মোবাইল ছাড়া অন্য কারো ল্যাপটপ বা মোবাইলে ফেসবুক ব্যবহার না করাই শ্রেয় এতে আইডি লগ আউট না হলে পাসওয়ার্ড সংরক্ষিত হয়ে যাওয়ার আশংকা থাকে। প্রয়োজনে সবসময় আইডি উন্মুক্ত না রেখে আইডি নিষ্ক্রীয় অর্থাৎ ডিএক্টিভেট করে রাখলেও এ ধরনের সাইবার ক্রাইমের হয়রানি থেকে অনেকাংশে রেহাই পাওয়া যায়। তারপরও যদি কারো মনে অত্যাধিক সংশয় থাকে তাহলে ফেসবুকের হেল্প সেন্টারে গিয়ে পার্মানেন্টলি ডিলিট অপশনে ক্লিক করে সে নিজে তার আইডি মুছে ফেলতে পারে। তবে সে যদি চায় মোবাইল বা ল্যাপটপের নোটপ্যাড অথবা গুগল ড্রাইভে কিংবা পেন ড্রাইভে যাবতীয় তথ্য, ছবিগুলো নিজের ব্যক্তিগত ফাইলে দলিল রূপে রাখতে পারে।