সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক

তৃণমূল মানুষের স্বাস্থ্য সেবায় কমিউনিটি ক্লিনিক হেলথ কেয়ার প্রকল্প এখন স্বাস্থ্যসেবায় মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। মা ও শিশুর পাশাপাশি সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় এক নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে এই ক্লিনিক।

প্রথমদিকে সচেতনতার অভাবে কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা গ্রহিতাদের ভিড় না থাকলেও এখন ক্লিনিকগুলোতে রোগীর ভিড় ক্রমশ বাড়ছে। এই ক্লিনিকের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো বাড়ির কাছাকাছি হওয়ায় এবং সেখানে বিনামূল্যে সাধারণ রোগের ওষুধ পাওয়া যায় বলে দিন দিন এর সেবাগ্রহীতার সংখ্যাও বাড়ছে। সরকারের পৃথক দুটি জরিপেও এসব ক্লিনিক নিয়ে ৮০ থেকে ৯৮ শতাংশ মানুষ তাদের সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন। জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের (নিপোর্ট) এর এক জরিপে দেখা গেছে, বাড়ির পাশের ক্লিনিক থেকে ওষুধ আর পরামর্শ পেয়ে ৮০ শতাংশ মানুষই সন্তুষ্ট। জাতীয় রোগ প্রতিরোধ ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)-এর জরিপে দেখা যায়, সেবা নিয়ে ৯৮ শতাংশ মানুষ সন্তুষ্ট।

গ্রামীণ জনগনের অত্যাবশ্যকীয় চিকিৎসা সেবা বিতরণের প্রথম স্তর হলো কমিউনিটি ক্লিনিক। তৃণমূল পর্যায়ে সাধারণ মানুষের চাহিদা অনুসারে ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার হিসেবে শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগে কমিউিনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়। এখানে কর্মরত কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার, স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার কল্যাণ সহকারীগণ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকেন, যেমন- স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সেবা সম্পর্কে উদ্বুদ্ধকরণ; প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সেবা প্রদান; মা ও শিশুর খাদ্য ও পুষ্টির বিষয়ে সহায়তা প্রদান; ছোঁয়াচে রোগবালাই থেকে দূরে থাকার বিষয়ে পরামর্শ দান এবং জটিলতর রোগের চিকিৎসার জন্য উপজেলা ও জেলা হাসপাতালে প্রেরণ। তাছাড়াও করোনা সংক্রমণকালিন বীরের মতোই লড়াই করেছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা।

নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম উপজেলা সদর কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার উজ্জল কুমার বাসসকে বলেন, এই কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পের কারণে দেশের দরিদ্র মানুষ আজ সঠিক ভাবে স্বাস্থ্য সেবা পাচ্ছে। কমিউনিটি ক্লিনিক গুলোতে রোগীর সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক রেড়েছে। গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৮০ জন রোগীকে এখান থেকে সেবা দেয়া হয়।এই ক্লিনিকে সেবা নিতে আসা বিলকিস বেগম জানান, এই ক্লিনিকে সব চিকিৎসা হয়। ক্লিনিক থেকে বিনামূল্যে ওষুধ দেয়া হয়। আগে শহরে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হতো। সময় লাগতো বেশী, টাকাও খরচ হতো। কিন্তু এখন আর শহরে যেতে হয় না। আমরা সকল রোগের চিকিৎসা কমিউনিটি ক্লিনিক থেকেই পাচ্ছি।

সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ থানার কুসম্বি কমিউনিটি ক্লিনিকের হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার অমৃত প্রমাণিক বাসসকে বলেন, করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে লোকজন এখন জ্বর, সর্দি, কাশি হলে জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে যান না। এ জন্য গ্রাম এলাকার লোকজন আমাদের কাছেই ভিড় করছেন। আগে গড়ে প্রতিদিন একটি কমিউনিটি ক্লিনিকে ৩০-৪০ জন রোগী পাওয়া যেত, এখন আসছে তার দ্বিগুণ। ক্লিনিকে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা লিপন সরকার বলেন, গত কয়েক দিন যাবত জ্বর, সর্দি ও কাশিতে ভুগছি। আমরা পক্ষে ১৪ কিলোমিটারের বেশি দূরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাওয়া সম্ভব নয়। আর বাড়ির কাছেই যদি আমরা প্রাথমিক ভাবে বিনামূল্যে সকল রোগের চিকিৎসা ও বিনামূল্যে ওষুধ পাই, তাহলে ১৪ কিলোমিটার দূরে যাবো কেন ?

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, দেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে মোট কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মানের লক্ষ্য মাত্রা ১৩ হাজার ৮৬১ টি। বর্তমানে ১৩ হাজার ৩৭৬টি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু রয়েছে। অবশিষ্ট ৪৮৫ টির মধ্যে ৩০০ টি জাইকা এবং ৩৬ টি পিপিডি এর অর্থায়নে নির্মিত হবে। ১৪৯ টি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মানের নির্দিষ্ট কোন আর্থিক সহায়তা সুনির্দিষ্ট হয়নি। ২০০৯ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিকে ভিজিটের সংখ্যা ১০০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে ২ কোটি ৩২ লাখের অধিক সংখ্যাক জটিল রোগীকে উচ্চতর পর্যায়ে রেফার করা হয়। এখানে ৩০ প্রকার ওষুধ বিনামূল্যে বিতরণের পাশাপাশি স্বাস্থ্য, পরিবার-পরিকল্পনা ও পুষ্টি বিষয়ক পরামর্শ দেয়া হয়। বাড়ির কাছের মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবার কারণে বড় ধরনের অসুখ ছাড়া উপজেলা ও জেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছে প্রান্তিক জনপদের মানুষেরা।

কমিউনিটি ক্লিনিক পরিদর্শন করে জানা যায়, এখানে সার্বিক প্রজনন স্বাস্থ্য পরিচর্যার আওতায় গর্ভবর্তী মহিলাদের প্রসব পূর্ব (প্রতিষেধক টিকাদানসহ) এবং প্রসব পরবর্তী (নবজাতকের সেবাসহ) সেবা দেয়া হয়। এই ক্লিনিকগুলোতে সময়মত প্রতিষেধক টিকাদান (যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, হুপিং কফ, পোলিও, ধনুষ্টংকার, হাম, হেপাটাইটিস-বি, নিউমোনিয়া ইত্যাদি) শিশু ও কিশোর কিশোরীদের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা দেয়া হয়। জনগণের জন্য বিশেষ করে মহিলা ও শিশুদের অপুষ্টি দূরীকরণের জন্য ফলপ্রসূ ব্যবস্থ্য গ্রহণ ও সেবা প্রদান করা হয়। ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, কালা-জ্বর, ডায়রিয়াসহ অন্যান্য সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং সেগুলোর সীমিত চিকিৎসা সুবিধা রয়েছে। সাধারণ জখম, জ্বর, ব্যথা, কাটা/পোড়া, দংশন, বিষক্রিয়া হাঁপানী চর্মরোগ, ক্রিমি এবং চোখ, দাঁত ও কানের সাধারণ রোগের ক্ষেত্রে লক্ষণ ভিত্তিক প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করা হয়। অস্থায়ী পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সংক্রান্ত বিভিন্ন উপকরণ, যেমন-কনডম, পিল, ইসিপি ইত্যাদি সার্বক্ষণিক সরবরাহ ও বিতরণ নিশ্চিত করা হয়। জটিল রোগীদের প্রয়োজনীয় প্রাথমিক সেবা প্রদান করে দ্রুত উচ্চতর পর্যায়ে রেফার করা হয়। সদ্য বিবাহিত ও অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের নিবন্ধিকরণ ও সম্ভাব্য প্রসব তারিখ সংরক্ষণ করতে হয়। মহিলা ও কিশোর-কিশোরীদের রক্তস্বল্পতা সনাক্ত এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান করা হয়।

কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ার-এর (সিবিএইচসি) লাইন ডিরেক্টর ডা. মাসুদ রেজা কবির বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবার কারণেই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ গ্রামীণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবার মান বেড়েছে। হাতের কাছে ফ্রি চিকিৎসা সেবা ও ওষুধ পেয়ে সবাই খুশি। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার হওয়ায় সাধারণ মানুষের আস্থাও বেড়েছে। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোই হবে দেশের স্বাস্থ্যসেবার পরিসংখ্যানের তথ্য ভান্ডার। চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর উন্নয়ন কর্মসূচির ২৭টি অপারেশনাল প্ল্যানের মধ্যে রয়েছে কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ার (কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প)। এই প্রকল্পের কার্যপরিধি ও অবকাঠামো আরও বৃদ্ধি পাবে।

কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডাররা (সিএইচসিপি) শুক্রবার এবং সরকারি ছুটির দিন ব্যতীত প্রতিদিন কমিউনিটি ক্লিনিকে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত উপস্থিত থাকেন। তারা ক্লিনিক খোলা এবং বন্ধ করা, রোগীর উপস্থিতি রেজিস্টারে নাম তোলা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নিশ্চিত করাসহ তাদের কর্মপরিধির আওতাধীন সেই মুহূতের সব কর্মকান্ডই পরিচালনা করে থাকেন।

আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ১৯৯৬ সালে সারাদেশে সাড়ে ১৩ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৮ সালে প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়। ওই সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার পাটগাতী ইউনিয়নের গিমাডাঙ্গা কমিউনিটি ক্লিনিক উদ্বোধন করেন। ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকার এই প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। এরপর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে ২০০৯ সালে আবার প্রকল্পটি চালু করে। খবর-বাসস

আজকের বাজার/আখনূর রহমান