সামরিক শক্তিতে মার্কিন ভাবনাকেও অতিক্রম করেছে চীন

চীনের সামরিক শক্তি যে গতিতে বাড়ছে তা অনেক বিশ্লেষকের হিসাবকেই অতিক্রম করে গেছে। লন্ডনের ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (আইআইএসএস) বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, নিজস্ব সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে ওয়াশিংটন যেমনটি ভেবেছিল সেই মাত্রা অনেকটাই ছাড়িয়ে গেছে চীন এবং রাশিয়া।

এর মধ্যে চীন তার সামরিক সরঞ্জামের আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে বেশি এগিয়েছে, বিশেষ করে নৌ ও বিমান বাহিনীর ক্ষেত্রে।

আইআইএসএস-এর ১৯৫৯ সালের বৈশ্বিক বিবেচনায় সামরিক দক্ষতা এবং প্রতিরক্ষা ব্যয়ের বার্ষিক মূল্যায়নকে কেন্দ্র করে, এই সামরিক ভারসাম্য বিবেচনা করা হয়েছে।

বিবিসি বাংলা এক প্রতিবেদনে বলছে, অবশ্য সামরিক ক্ষেত্রে চীনের রূপান্তর এক সময়ে খুব বেশি হয়নি। তবে এখন অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য হারে চীনের সামরিক সমৃদ্ধি এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে তাকে ওয়াশিংটনের নিকট প্রতিদ্বন্দ্বীই বলা যেতে পারে।

ভারসাম্যের গতি পরিবর্তন?

গত সপ্তাহের শেষ দিকে ‘দ্য মিলিটারি ব্যাল্যান্স ২০১৮’ বা ২০১৮ সালের বার্ষিক সামরিক ভারসাম্য প্রতিবেদন প্রকাশের পর আইআইএসএস-এর কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলেছেন বিবিসির প্রতিবেদক।

প্রতিবেদনটিতে তিনি বিভিন্ন পরিসংখ্যান এবং সংক্ষিপ্ত সার থেকে আরো বিস্তারিত বোঝার চেষ্টা করেছেন যে, বিশ্বের সামরিক শক্তির উত্থানের গতি প্রকৃতি।

অতি দূর পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র বা আলট্রা লং রেঞ্জ ব্যালিস্টিক মিসাইল থেকে শুরু করে পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধ বিমান- এসবের উদ্ভাবন চীনের অগ্রগতি এবং অসাধারণ প্রযুক্তিগত ক্ষমতারই প্রকাশ।

মার্কিন ভাবনারও সীমা ছাড়িয়ে গেছে চীন

গত বছর টাইপ-৫৫ ক্রুজার- ছিল তাদের বহরে সংযোজিত সর্বশেষ যুদ্ধ জাহাজ- যা কিনা ন্যাটো-র অন্তর্ভুক্ত যেকোনো নৌ বাহিনীর জন্যই ভাবনার বিষয় হতে পারে।

এখন চীন কাজ করছে এমন একটি বিমানবাহী রণতরী নিয়ে, যা কিনা সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে যুগ্ম-সামরিক সদর দপ্তর হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

অস্ত্রশস্ত্র, বিমান প্রতিরক্ষা থেকে শুরু করে পদাতিক আক্রমণের সব ধরনের ব্যবস্থাই রয়েছে তাতে, ঠিক যেমনটি যুক্তরাষ্ট্রেরও রয়েছে।

নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে চীন রাশিয়ার কাছ থেকে উন্নত সামরিক প্রযুক্তি পেয়েছিল। সেটি তাদের সহায়তা করে নৌ আর বিমান বাহিনীকে শক্তিশালী করতে।

এখন বেশি আলোচনায় আছে চীনের ফিফথ জেনারেশন ফাইটার বা পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান। যাতে কিনা রয়েছে ‘স্টিলথ প্রযুক্তি’, যার ফলে এটির সুপারসনিক বা শব্দের চেয়ে বেশি গতি সম্পন্ন এবং অতি সূক্ষ্ম বিমান প্রযুক্তি দিয়ে নির্মিত।

তবে ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ-এর বিশেষজ্ঞদের এ নিয়ে কিছু সন্দেহ রয়েছে।

তাদের একজনের মতে, ‘নিচ দিয়ে উড়ে যেতে সক্ষম এমন বিমান চালানোর ক্ষেত্রে চীনা বিমান বাহিনীর এখনো উপযুক্ত কৌশলে উন্নতি করতে হবে। সেই সাথে চতুর্থ প্রজন্মের বিমানের প্রযুক্তির আরো কিছু সংমিশ্রণ ঘটাতে হবে এই পঞ্চম প্রজন্মের বিমানে।’

তারপরও এক্ষেত্রে চীনের অগ্রগতি সুস্পষ্ট বলেই মত দেন তিনি। বিশেষ করে এয়ার টু এয়ার বা বিমান থেকে বিমানে আঘাত করে এমন ক্ষেপণাস্ত্রের ক্ষেত্রে এটি যেকোনো পশ্চিমা শক্তির সাথে পাল্লা দিতে পারে বলেই মনে করেন সেই সামরিক বিশেষজ্ঞ।

শীতল যুদ্ধের শেষে এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র অনেক বেশি এগিয়ে থাকলেও চীন এখন সে অবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে বলেই ইঙ্গিত দিয়েছে আইআইএসএস-এর বিশ্লেষণ। বিশেষ করে, চীনের দূর-পাল্লার এয়ার টু এয়ার ক্ষেপণাস্ত্রের সক্ষমতা তাকে সে অবস্থায় নিয়ে এসেছে।

আইআইএসএস-এর ‘মিলিটারি ব্যাল্যান্স’ এর রচয়িতা বলছেন যে, ২০২০ সাল পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে চীন এই ক্ষেপণাস্ত্রের উন্নয়ন ঘটিয়ে যাচ্ছে।

তবে আধুনিকায়নের হিসেবে পিছিয়ে আছে চীনের পদাতিক বাহিনী। চীনা সামরিক বাহিনী ব্যবহৃত অন্তত অর্ধেক সমরাস্ত্রকে আধুনিক হিসেবে বিবেচনা করা যায় না।

তবে সেখানেও থেমে নেই চীন। ২০২০ সাল পর্যন্ত উন্নয়নের একটি লক্ষ্যমাত্রা ধরে তারা ‘যান্ত্রিক’ এবং ‘তথ্যগত’ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

চীন এসব সমরাস্ত্রের উন্নতি করে যাচ্ছে স্পষ্টতই একটি কৌশলকে সামনে রেখেই। সমরবিদ্যার ভাষায় একে বলা যায় ‘এন্টি এক্সেস এরিয়া ডিনায়াল’, এতে চীনের লক্ষ্য মার্কিন বাহিনীকে যতটা সম্ভব তার ভূমি থেকে দূরে রাখা।

সেই কৌশলকে মাথায় রেখেই দূর পাল্লার বিমান হামলা ও নৌ বাহিনীর সক্ষমতা বাড়িয়ে যাচ্ছে চীন, যা কিনা মার্কিন রণতরীকে প্রশান্ত মহাসাগরের দূরবর্তী স্থানেই প্রতিহত করতে পারে।

চীন কেবল সমরাস্ত্রের উন্নতি ঘটিয়েই প্রবল পরাশক্তি হচ্ছে না। অস্ত্র রপ্তানির বাজারেও চীনের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা তাৎপর্যপূর্ণ।

মানববিহীন যুদ্ধবিমান যা ড্রোন নামেই বেশি পরিচিতি পেয়েছে তার বাজারের হিসাবই যদি করা যায়। যুক্তরাষ্ট্র যদিও সবার আগে একে বিশ্বে পরিচিত করে তোলে। আর তাদের তৈরি এসব মানববিহীন যুদ্ধবিমান বিক্রিতেও মার্কিনীরা কেবল বেছে নেয় খুব কাছের মিত্রদের যেমন যুক্তরাজ্য বা ফ্রান্স।

তবে চীনের এমন কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। ‘মিলিটারি ব্যাল্যান্স’-এর তথ্য মতে, চীনের তৈরি সশস্ত্র মানববিহীন যুদ্ধ বিমান কিনেছে মিসর, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে শুরু করে মিয়ানমার পর্যন্ত।

অস্ত্র বাণিজ্যের দিক থেকে চীন এখন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে উদীয়মান হুমকি।

বিশ্লেষকদের মতে, চীন যেসব অস্ত্র বিক্রি করে সেগুলো পশ্চিমা অস্ত্রের অন্তত ৭৫ ভাগ সক্ষমতা সম্পন্ন, কিন্তু দাম সেগুলোর প্রায় অর্ধেক, বাণিজ্যের বিচারে যা আসলে অবশ্যই খুবই লাভজনক পরিস্থিতি।

স্থলযুদ্ধের সমরাস্ত্র বিক্রির ক্ষেত্রে অবশ্য চীন এখনো কিছুটা পিছিয়ে। তাদের এখনো রাশিয়া বা ইউক্রেনের অস্ত্রের ক্রেতাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হচ্ছে।

তবে ২০১৪ সালে কিয়েভ যখন থাইল্যান্ডে তাদের ট্যাঙ্ক বিক্রি করতে ব্যর্থ হলো তখন সেই বাজার দখল করলো চীনের ভিটিফোর ট্যাঙ্ক।

আইআইএসএস-এর বিশ্লেষকদের মতে চীন এখন আফ্রিকার কিছু দেশের কথা মাথায় রেখে ট্যাঙ্ক তৈরি করছে। যেখানে রাস্তাঘাট খুব উন্নত নয়- সেসব দেশের জন্য হালকা ওজনের ট্যাঙ্ক বানানোর চেষ্টা চলছে।

চীনের অত্যাধুনিক অস্ত্র উদ্ভাবন কেবল তাদের প্রতিবেশীদেরই নয়, অন্য অনেক দেশকেই এখন চিন্তায় ফেলছে। পশ্চিমা দেশগুলো বিমান যুদ্ধের প্রযুক্তি আর সক্ষমতার দিক দিয়ে অন্তত তিন দশক আধিপত্য বিস্তার করে আসলেও এখন চীনের কৌশল সেটিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে।

চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করা চীনের সামরিক প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম ক্রেতাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতার বাড়িয়ে তুলছে।

একটি পশ্চিমা ইউরোপীয় দেশকে হয়তো কখনো চীনের সাথে সরাসরি যুদ্ধ করতে হবে না। তবে অন্যদের হাতে অত্যাধুনিক চীনা অস্ত্রের মুখোমুখি হয়তো তাদের হতেই পারে। সূত্র: বিবিসি বাংলা।

আজকের বাজার/ এমএইচ