বলিউড সুপারস্টার সালমান খানকে যোধপুরের এক আদালত বৃহস্পতিবার কারাদণ্ড দিয়েছিল। আর তার পরের দিনই তার জামিনে মুক্তির আবেদনের শুনানি শুরু হয় জেলা দায়রা জজের এজলাসে। কারাদণ্ডের আদেশ দেয়ার পর এত তাড়াতাড়ি কি কোনো সাধারণ নাগরিকের জামিন-মামলার শুনানি শুরু হয়?
না কি সুপারস্টার, ভিআইপি বলেই সালমান খানের জামিনের আবেদন পেশ হওয়ার দুদিনের মধ্যেই সেই আবেদন মঞ্জুর করে দিলেন আদালত?
সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অলোক কুমার বলছিলেন, এটি ঠিকই যে সারা দেশের সব আদালতেই বহু মামলা দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে, যার মধ্যে জামিনের আবেদনও অনেক দিন ধরে ঝুলে থাকে। একজন উকিল হিসেবে বলতে পারি- এই দীর্ঘসূত্রতার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে।-খবর বিবিসি অনলাইন।
তিনি বলেন, যদি উকিল বুদ্ধিমান হন, তা হলে মূল মামলার আদেশ বের হওয়ার আগেই জামিনের আবেদন তৈরি করে ফেলেন তিনি। সাজা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জামিনের আবেদন জানিয়ে দিতে পারেন তিনি। কিন্তু বেশিরভাগ উকিলই সেটি করেন না। আদালত কী নির্দেশ দেন, সেটি দেখে এর পর পুরো রায় পড়ার জন্য সময় নেন তারা। এর পরে জামিনের আবেদন জানানো হয়। এতেই অনেকটা সময় চলে যায়।
অলোক কুমার বলেন, তবে কোনো বিচারক কবে জামিনের আবেদন শুনবেন, সেটি ঠিক করার অধিকার তার রয়েছে। সেই অধিকার কখনও ব্যবহার করা হয়, কখনও করা হয় না।
আরেক সিনিয়র আইনজীবী সঞ্জয় হেগড়ে বলছিলেন- সালমান খানের জামিন মামলার যে দ্রুত শুনানি হয়েছে, এটিই তো স্বাভাবিক। এটি আদালতের বিশেষ অধিকারের মধ্যেই পড়ে। তবে এমন মামলার ক্ষেত্রে অনেক সময়েই বিচারকরা চাপে পড়ে যান। বিশেষত যদি সংবাদমাধ্যম বা সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো মামলা নিয়ে খুব বেশি উৎসাহ থাকে, সেই সব মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করে দিতে চান তারা।
ঠিক এই বিষয় নিয়েই ২০০৪ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট একটি আদেশ দিয়েছিলেন।
অমরাবতী বনাম উত্তরপ্রদেশ সরকারের মধ্যে ওই মামলার রায় দিতে গিয়ে এলাহাবাদ হাইকোর্ট বলেছিলেন, কোনো জামিন আবেদনের ওপরে সেদিনই আদেশ দিতে হবে, এমন নির্দেশ যদি হাইকোর্ট থেকে দেয়া হয়, তা হলে সেটি নিম্নআদালতগুলোর কাজে হস্তক্ষেপ করা হবে।
ভারতীয় ফৌজদারি কার্যবিধি বা ক্রিমিন্যাল প্রসিডিওর কোডের ৪৩৭ আর ৪৩৯ ধারা অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেটদের এই অধিকার দেয়া হয়েছে যে তিনি জামিন আবেদন পেশ হওয়ার দিনেই আদেশ দিয়ে দিতে পারেন। তবে সেদিন যদি জামিনের আবেদনের ওপরে কোনো নির্দেশ তিনি না দেন, তা হলে তার কারণ লিখিতভাবে রেকর্ড করে রাখতে হবে ওই ম্যাজিস্ট্রেটকে।
অলোক কুমার বলেন, শুধু নিম্নআদালতে নয়, সুপ্রিমকোর্টেও জামিনের আবেদন নিয়ে শুনানিতে অসামঞ্জস্য দেখা যায়। কোনো মামলায় হয়তো চার বছরেও জামিন পাওয়া যায়নি, আবার একই ধরনের অন্য একটি মামলায় দেখা গেছে চার মাসেই জামিন পাওয়া গেছে।
তিনি বলেন, তবে একই সঙ্গে এ রকম উদাহরণও আছে, যেখানে জেলা আদালত বা হাইকোর্ট গরিব বা সাধারণ কোনো ব্যক্তির মামলাকে অন্যান্য মামলার থেকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। কিন্তু এটিও ঘটনা, কোনো সিনিয়র আইনজীবীর করা মামলায় হয়তো তাড়াতাড়ি শুনানির দিন ধার্য হল আর জুনিয়র উকিলদের মামলার ক্ষেত্রে বলা হল আগে থেকেই অনেক মামলা জমে রয়েছে আদালতে।
সুপ্রিমকোর্টেরই সিনিয়র আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ অবশ্য বলছিলেন- সালমান খানের মামলায় নিয়মের বিশেষ ব্যতিক্রম হয়নি। জামিন মামলার দ্রুত শুনানি হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
তিনি বলেন, যে কোনো জামিনের আবেদনই দ্রুত শুনানি হওয়া উচিত। কিন্তু সাধারণভাবে দেখা যায় যে গরিব মানুষের ভাগ্যে এ রকমটা হয় না। ব্যবস্থাটাই এ রকম হয়ে গেছে। ভিআইপিদের হাতে বড় বড় উকিল থাকে, তাদের হাতে অর্থ থাকে, প্রভাব থাকে। তাদের জন্য ন্যায়বিচার পাওয়াটা সুবিধাজনক।
ভিআইপিদের মামলাগুলোর ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্টও দুবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন।
২০১৩ সালে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি বিএস চৌহান বলেছিলেন- ভিআইপিরা আদালতের বেশি সময় নিয়ে নেন। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের মামলাগুলোর জন্য সময় কম পড়ে যায়।
ওই বিচারপতি বলেন, আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, সাধারণ মানুষ আমাদের কাছ থেকে কম সময় পান। এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক। ২০১৪ সালেও সর্বোচ্চ আদালত আরেকটি ভিআইপি মামলাতেও যে মন্তব্য করেছিলেন, সেটিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
হরিয়ানা রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওম প্রকাশ চৌথালার জামিন আবেদনের শুনানিতে বলা হয়েছিল যে, স্বাস্থ্যের অবনতির কারণে তার জামিনের সময় বাড়ানো হোক।
বিচারপতি এইচএল দাত্তু ও বিচারপতি এসজে মুখোপাধ্যায়ের বেঞ্চ ওই আবেদনের শুনানিতে মন্তব্য করেছিলেন, যখনই কোনো নামজাদা ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হন, তখনই তিনি হাসপাতালে ভর্তি হতে চান। এই ব্যাপারটিতে উৎসাহ দিলে গোটা ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়বে।
এস/