হার্ট অ্যাটাক হলে তা করণীয় এবং প্রতিরোধে যে সকল পদক্ষেপ নিতে হবে

হার্ট অ্যাটাক করণীয় প্রতিরোধ:-

হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ সমূহ, প্রতিরোধের উপায়, হঠাৎ আক্রান্ত হলে তাৎক্ষণিক করণীয়:-

যখন হার্টের পেশীর একটি অংশ পর্যাপ্ত রক্ত পায় না, ঠিক তখনি হার্ট অ্যাটাক হয়। রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিক হতে যত বেশি সময় যায়, হার্টের পেশীর তত বেশি ক্ষতি হয়। সাধারণত করোনারি ধমনীর মারাত্মক খিঁচুনি বা আকস্মিক সংকোচনের ফলে হৃদপিণ্ডের পেশীতে রক্ত প্রবাহ বন্ধ হতে পারে। চলুন, ভয়াবহ এই হৃদরোগটির লক্ষণ ও প্রতিরোধের পাশাপাশি জেনে নিই- হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক হলে তাৎক্ষণিকভাবে কি করবেন।

হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণসমূহ:-

দেহের বিভিন্ন অংশে ব্যথা বা অস্বস্তি:-

বেশিরভাগ হার্ট অ্যাটাক-এর সময় বুকের মাঝখানে বা বাম দিকে ব্যথা বা অস্বস্তি শুরু হয়, যা কয়েক মিনিটের বেশি স্থায়ী হয় অথবা কখনো হঠাৎ চলে যেয়ে আবার ফিরে আসে। কখনও কখনও এই অস্বস্তি ঘন্টাখানেক পর বা এমনকি এক দিন পরে ফিরে আসে। এমনটা হলে বুঝতে হবে যে, আপনার হার্টের পেশী পর্যাপ্ত অক্সিজেন পাচ্ছে না।

বুক ব্যথা হার্ট অ্যাটাকের একটি সাধারণ লক্ষণ। অনেকে এই ব্যথাকে ব্যথা বলে না বলে বুকে চাপ অনুভব করছে বলে। কিন্তু এটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে, বুক ব্যথা প্রতিটি হার্ট অ্যাটাকের সময় নাও হতে পারে।

অনেকেই হার্ট অ্যাটাকের সময় তলপেটের উপরের দিক, কাঁধ, পিঠ, ঘাড়/গলা, দাঁত বা চোয়াল ইত্যাদি স্থানে ব্যথা অনুভব করে। মহিলাদের ক্ষেত্রে বিশেষ করে তলপেটে এবং বুকের নিচের অংশে ব্যথা করে। পিঠের উপরের দিকে ব্যথা সাধারণত পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের ক্ষেত্রেই বেশি দেখা যায়।

সারাদিন ধরে প্রচণ্ড ঘাম:-

আপনি যদি ব্যায়াম না করেন, তাহলে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঘাম হওয়া আপনার হার্ট অ্যাটাকের প্রাথমিক কারণ হতে পারে। জমে থাকা ধমনীর মধ্য দিয়ে রক্ত পাম্প করতে যেয়ে আপনার হৃদযন্ত্র বেশি পরিশ্রম করে, কাজেই শরীরের তাপমাত্রার ভারসাম্য ঠিক রাখতে আপনার শরীর বেশি ঘাম ছেড়ে দিতে থাকে। অনেক সময় রাতের বেলা অতিরিক্ত ঘামের জন্য চাদর ভিজে যায় বা ঘুম হয় না। এটিও হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ হতে পারে, বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে।

প্রচণ্ড ক্লান্তি ও নিঃশ্বাসের দূর্বলতা:-

হার্ট অ্যাটাকের সময় বুকে অস্বস্তির সাথে অথবা আগে নিঃশ্বাসের দুর্বলতাও অনুভূত হতে পারে। মুলত রক্ত প্রবাহের একটি এলাকা বন্ধ থাকার কারণে আপনার হৃদযন্ত্র অতিরিক্ত চাপের ফলে পাম্প করার চেষ্টা করে। ফলে আপনার প্রচন্ড অবসন্ন অনুভূত হয়। যদি আপনি প্রায়শই বিনা কারণে ক্লান্ত হন, তাহলে ব্যাপারটিকে কোনভাবেই উপেক্ষা করা চলবে না।

ক্লান্তি এবং শ্বাসকষ্ট পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে বেশি দেখা যায় এবং এমনকি হার্ট অ্যাটাকের কয়েক মাস আগে থেকেও শুরু হতে পারে। আপনার শ্বাস -প্রশ্বাস এবং হৃদযন্ত্রের কার্যকরীভাবে রক্ত পাম্পিং; পরস্পর খুব ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। আপনার হৃদযন্ত্র রক্ত পাম্প করে যাতে এটি আপনার টিস্যুতে রক্ত সঞ্চালন করতে এবং ফুসফুস থেকে অক্সিজেন পেতে পারে। হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে যখন আপনার হার্ট ভালভাবে রক্ত পাম্প করতে পারে না, তখনি শ্বাসকষ্ট শুরু হয়।

দ্রুত হৃদস্পন্দন:-

দ্রুত হৃদস্পন্দনের সময় মনে হয় হৃদযন্ত্রটা বুকের ভেতর জোরে জোরে ধাক্কা মারছে বা বুক ধড়ফড় করছে। আপনার হৃদযন্ত্র এবং শরীর আপনার শরীরের সর্বত্রে রক্ত সঞ্চালনের জন্য একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও নিরবচ্ছিন্ন বিটের উপর নির্ভর করে। যে কোন একটি ছন্দপতন আপনার হার্ট অ্যাটাকের কারণ হতে পারে।

মাথা ঘোরা ও বমি বমি ভাব বা বমি:-

হার্ট অ্যাটাকের আগে মাথা ঘোরা অনুভূত হতে পারে। অতিরিক্ত পরিশ্রম করার সময় আপনি মাথা ঘুরে পড়ে যেতে পারেন। হার্ট অ্যাটাকের অন্যান্য উপসর্গগুলোর মধ্যে বমি বমি ভাব বা বমিও অন্তর্ভুক্ত। বিশেষত মহিলাদের এই উপসর্গ দেখা দেয়ার সম্ভাবনা বেশি।

হার্ট অ্যাটাকের সময় তাৎক্ষণিকভাবে করণীয়:-

তাৎক্ষণিকভাবে হার্ট অ্যাটাক বন্ধ কোন মতেই সম্ভব নয়। কিন্তু এসময় জরুরি চিকিৎসার সরণাপন্ন হওয়ার পাশাপাশি নিচের পদক্ষেপগুলো নেওয়া যেতে পারে।

১৬২৬৩-তে কল করা:-

এটি হার্ট অ্যাটাকের সময় সেবা পাওয়ার দ্রুততম ও নিরাপদ উপায়। ১৬২৬৩ তে কল করে ২ প্রেস করে সরাসরি অ্যাম্বুলেন্সের পরিষেবা নিতে পারেন।

দরজা-জানালা খুলে আরামদায়ক বিশ্রামের ব্যবস্থা:-

হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত ব্যক্তি বাড়ির ভেতর থাকলে তার আশেপাশের লোকজন ঘরের দরজা-জানালা খুলে বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এছাড়া এতে অ্যাম্বুলেন্স দল যতদ্রুত সম্ভব বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে আক্রান্ত ব্যক্তিকে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যেতে পারবে।

অ্যাম্বুলেন্স আসা পর্যন্ত আক্রান্ত ব্যক্তিটিকে একটি আরামদায়ক অবস্থানে বিশ্রাম নেয়ার ব্যবস্থা করুন। বিশ্রাম হার্টের চাপ কমায় কারণ এটি শরীরের সর্বত্র রক্ত পাম্প করার চেষ্টা করে।

আঁটসাঁট পোশাক আলগা করা:-

আঁটসাঁট পোশাক, যেমন নেকটি বা বেল্টগুলি আলগা করে দিন। এতে আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাস নেওয়া সহজ হবে। এছাড়া অ্যাম্বুলেন্স দলের জন্যও ঢিলেঢালা জামাকাপড় পরিহিত ব্যক্তিকে দ্রুত অ্যাম্বুলেন্সে নেয়া সহজ হবে।

প্রাথমিক সিপিআর:-

আক্রান্ত ব্যক্তিতে ঘুমিয়ে পড়া থেকে বিরত রাখুন। তার সাথে অবিরত কথা বলতে থাকুন। মাথাটি দেহের সাথে ৩০-৪৫ ডিগ্রি কোণ করে উচু অবস্থায় রাখুন। এতে তার শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া সহজ হবে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে চিৎ করে শুইয়ে দিন। তারপর আপনার এক হাতের আঙ্গুলগুলোর ফাঁকে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে অন্য হাতের আঙ্গুলগুলো ঢুকিয়ে (এই পদ্ধতি কার্ডিয়াক পালমোনারি রিসাসিটেশন (সিপিআর) হিসেবে বহুল পরিচিত) আপনার পুরো শরীরের ভর আলিঙ্গনবদ্ধ দুই হাতের উপর চাপিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তির বুকের মাঝখানে পাম্প করতে থাকুন। ১৬-১৮ সেকেন্ড ধরে ৩০ বার এভাবে পাম্প করুন। রোগীর নাক দু’আঙ্গুলে চেপে চিবুক উচু করে দিন। তারপর আবার বুকে পাম্প শুরু করুন। কমপক্ষে পাঁচবার প্রক্রিয়াটি পুনরাবৃত্তি করুন।

হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধের উপায়:-

সুষম খাদ্য গ্রহণ:-

সুষম খাদ্য খাওয়া আপনার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা কমাতে সাহায্য করে। সুষম খাবারের তালিকায় ফল, সবজি, শাকসবজি, বাদাম, চর্বিহীন প্রোটিন এবং মাছ অন্তর্ভুক্ত থাকে। পাশাপাশি প্রতিদিনের খাবারে প্রক্রিয়াজাত মাংস, পরিশোধিত কার্বোহাইড্রেট এবং মিষ্টি পানীয়ের পরিমাণও সীমিত করা উচিত।

শারীরিক ব্যায়াম:-

শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকা হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধে সাহায্য করে। প্রাপ্তবয়স্কদের সম্ভব হলে প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট মাঝারি বা ৭৫ মিনিট জোরালো ব্যায়াম করার চেষ্টা করা উচিত। আর যারা ইতিমধ্যে সক্রিয়, তাদের কার্যকলাপের মাত্রা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি করতে পারেন।

পরিমিত ওজন বজায় রাখা:-

পরিমিত ওজন বজায় রাখা হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধে একটি বড় ভূমিকা পালন করে। আপনার উচ্চতা এবং বয়স অনুসারে আপনার ওজন কতটা হওয়া উচিত তা পরীক্ষা করে নিতে পারেন। এটি আপনার ক্যালোরি গ্রহণ এবং প্রয়োজনে ব্যায়ামের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করবে।
ধূমপান পরিত্যাগ

যে কোন মূল্যেই ধূমপান বন্ধ করা উচিত। সিগারেট বা বাষ্পের মতো তামাকজাত দ্রব্যের ধোঁয়া হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিতে ফেলে দিতে পারে।
অন্যান্য শারীরিক সমস্যার চিকিৎসা

হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে এমন স্বাস্থ্যের অবস্থার চিকিৎসা করা হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধের আরেকটি উপায়। এই অবস্থার মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল, এবং ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্ত শর্করা অন্তর্ভুক্ত।

পর্যাপ্ত ঘুম:-

সুস্বাস্থ্যের জন্য সঠিক পরিমাণে ঘুমের কোন বিকল্প নেই। এমনকি এর ফলে উচ্চ রক্তচাপ ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়, যা হার্ট অ্যাটাকের কারণগুলোর মধ্যে একটি। ১৮-৬০ বছর বয়সী বেশিরভাগ প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতি রাতে ৭ বা তার বেশি ঘন্টা ঘুম প্রয়োজন।
পর্যাপ্ত পানি পান করা

প্রচুর পানি পান ডিহাইড্রেশন এড়াতে সাহায্য করে। রক্তরসে পানির পরিমাণ ৯০-৯২ শতাংশ তাই পানিশূন্যতাতে হৃদযন্ত্র ও সারা দেহে রক্ত সঞ্চালনে ব্যাঘাত ঘটে যা হার্ট অ্যাটাকের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

হার্ট অ্যাটাক নারী-পুরুষ উভয়েরই যেকোন বয়সে হতে পারে। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে এর ঝুঁকি বাড়তে থাকে। কিন্তু জীবন ধারণ নিয়ে একটু সতর্ক হলেই আপনি এই ঝুঁকি এড়াতে পারবেন। স্বাস্থ্য প্রত্যেকের কাছেই মহামূল্যবান সম্পদ। তাই শত কষ্ট হলেও এই সম্পদটি রক্ষার জন্য রুটিন মাফিক চলা উচিত। খবর-ইউএনবি

আজকের বাজার/আখনূর রহমান