হাসপাতালে সেবা নিতে গিয়ে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ নারী সেবা প্রদানকারীদের কাছ থেকে দুর্ব্যবহারের শিকার হন বলে নতুন এক গবেষণায় উঠে এসেছে।
অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের ‘গণপরিসরে নারীর প্রতি সহিংসতার প্রেক্ষিতে গণসেবা’ শীর্ষক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। জরুরী গণসেবা নিতে গিয়ে নানা ধরণের সমস্যা ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে নারীরা বেশি হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এতে সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে বলেও গবেষণায় উঠে এসেছে।
১৬ জুলাই রোববার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ আয়োজিত ‘গণসেবা প্রচারাভিযান ২০১৭: মানসম্মত গণসেবা’ বিষয়ক মতবিনিময় সভায় গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। সেখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা উন্নয়নমূলক সংস্থার প্রতিনিধিরা সেখানে গণসেবা নিয়ে প্রান্তিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন।
সভার শুরুতেই গবেষণার ফলাফল ও গণসেবা নিয়ে একটি ধারণাপত্র তুলে ধরেন অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের ম্যানেজার নুজহাত জেবিন।
খুলনা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও নারায়নগঞ্জ-সিটি কর্পোরেশনের পুলিশ প্রশাসন, সিটি করপোরেশন, পরিবহন কর্তৃপক্ষ, বাজার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এবং হাসপাতাল সেবা নিয়ে ৪০০ মানুষের উপর এ গবেষণাটি করা হয়।
গবেষণায় বলা হয়, অর্থায়ন, নীতির বাস্তবায়ন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও যাতায়াতের মতো গুরুত্বপূর্ণ গণসেবাগুলো জনমুখী নয়।
‘গণপরিসরে নারীর প্রতি সহিংসতার প্রেক্ষিতে গণসেবা’ নামক এ গবেষণায় দেখা গেছে, হাসপাতালে গিয়ে ৪২ দশমিক ৫ ভাগ নারী সেবা প্রদানকারীদের কাছ থেকে দুর্ব্যবহারের শিকার হন। শতকরা ৫০ ভাগ নারী মনে করেন, বাজারে তারা অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ বা এ ধরণের ঘটনার শিকার হন।
জরিপকৃত এলাকায় ৩০ ভাগ নারী মনে করেন যে, পুলিশ স্টেশনে তারা টিজিং-এর শিকার হন এবং শতকরা ৩৫ জন মনে করেন যে, তারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন।
২০১৬ সালের গোড়ার দিকে করা এ গবেষণায় দেখা গেছে, বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। আবার এই সকল স্থানে সহিংসতার কোন ঘটনা ঘটলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেগুলো যথাযথভাবে আমলে নেয়া হয় না বা সঠিক কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না।
প্রতিষ্ঠানটির নুজহাত জেবিন বলেন, চিকিৎসা, নিরাপত্তার বিষয়ে গণসেবা নিতে গিয়ে নানা ধরনের হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হন সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে নারীরা সমস্যায় বেশি পড়েন। মূলত: জন গুরুত্বপূর্ণ খাতে বাজেট বরাদ্দের অভাব, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবেই এমন অবস্থা।
গবেষণার ফলাফল নিয়ে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ-এর গণসেবার ধারণাপত্রে বলা হয়, বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ পর্যাপ্ত নয়। স্বাস্থ্যখাতে এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশে মাথাপিছু বাৎসরিক গড় বরাদ্দ ২৭ ডলার যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক উল্লিখিত দক্ষিণ এশিয়ায় গড় মাথাপিছু বরাদ্দের থেকে ২৫ শতাংশ কম।
গবেষণার ফলাফল ও গণসেবা খাতে সরকারের বরাদ্দ ও বিভিন্ন উদ্যোগের বিশ্লেষণ করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক জেষ্ঠ্য গবেষক প্রতিমা পাল মজুমদার।
প্রতিমা পাল বলেন, গণসেবা খাতে বাজেট না বাড়ার বড় কারণ রাজস্ব না বাড়া। আমরা নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের দেশ হয়ে গেছি। কিন্তু আয়কর দিচ্ছে কয়জন? অনেকেরই এখনও আয়কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা রয়ে গেছে। তাই রাজস্ব বাড়াতে নতুন উদ্ভাবনী কৌশল নিতে হবে। সরকারী বেসরকারী অংশীদারিত্বের মাধ্যমে আয় বাড়ানো সম্ভব।
স্বাস্থ্যখাতের মত জনগুরুত্বপূর্ণ খাতের খারাপ পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করেন এই গবেষক। তিনি বলেন, সেবা নিশ্চিত করতে সরকারের অনেক আইন ও নীতি আছে। তবে তার বাস্তবায়ন হয় না বলেই এই অবস্থা। এছাড়া যারা সেবা দেন তারা আন্তরিক না। আবার যারা সেবা দেয়ার জন্য সরকারী প্রতিষ্ঠানে বসে আছেন তাদের জেন্ডার নিয়ে ধারণা কম। তাই নারীরা সমস্যায় বেশি পরেন।
অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ও অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের পরিচালক আজগর আলী সাবরি বলেন, যদি সাধারণ মানুষের জন্য মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা হয় তাহলে সে কর্মক্ষম হবে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাই গণসেবা নিশ্চিত করতেই হবে। অর্থায়ন ও বিনিয়োগ বাড়াতে প্রচলিত ধারার বাইরে কর্পোরেট ট্যাক্সকে আমলে নিতে হবে।
গবেষণা ও ধারণাপত্রে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে গণসেবার মান উন্নত করতে অনেক অর্থায়ন করা হয়েছে। কিন্তু গণসেবা জেন্ডার সংবেদনশীল হতে অনেক দূর যেতে হবে। নারী প্রাত্যহিক জীবনের চাহিদা আর জাতীয় জীবনের চাহিদা পূরণ করতে অনেক দূর যেতে হবে। প্রতিষ্ঠানটি অন্তর্ভূক্তিমূলক জেন্ডার সংবেদনশীল গণসেবা কাঠামোর কিছু দাবি তুলে ধরে।
যার মধ্যে রয়েছে গণসেবায় সরকারিভাবে অর্থায়ন বাড়ানো।সরকারিভাবে সেবা প্রদান নিশ্চিত করা; স্বচ্ছ ও জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন; জবাবদিহিতামূলক গণসেবা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
এছাড়া সার্বিক গণসেবার পরিস্থিতি উন্নয়নে জনবান্ধব গণসেবার জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু দাবি তুলে ধরে প্রতিষ্ঠানটি। দাবিগুলো হলো, গতানুগতিক আয়কর, সারচার্জ এবং ভ্যাট-এর উপর নির্ভরশীল না হয়ে বিকল্প অর্থায়ন ব্যবস্থার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ করা; নারীদের কার্যকরী অংশগ্রহনের মাধ্যমে জেন্ডার বাজেট প্রণয়ন; গণসেবার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো জোরদার করতে হবে এবং স্থানীয় চাহিদার প্রতিফলন ঘটাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।
কার্যকরী গণসেবা নিশ্চিত করতে গত মাসের ২৩ জুন থেকে দেশব্যাপী ‘গণসেবা প্রচারাভিযান’ পরিচালনা করছে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ। ঢাকার মতবিনিময় সভার মধ্য দিয়ে ২৪দিনের এই প্রচারাভিযান শেষ হয়। এ উপলক্ষে সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে গণসেবার দাবিতে গণমিছিল করে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ ও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষ।
আজকের বাজার:এলকে/ এলকে/ ১৬ জুলাই ২০১৭