হৃদরোগের চিকিৎসায় ঈর্ষণীয় উন্নতি বাংলাদেশের

হৃদরোগের চিকিৎসায় ঈর্ষণীয় উন্নতি হয়েছে বাংলাদেশের। হৃদরোগ চিকিৎসায় এখন প্রায় দেশটি স্বয়ংসম্পূর্ণ। ৯৫ থেকে ৯৮ শতাংশ হৃদরোগের চিকিৎসার সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে। এর জন্য দক্ষ জনবল, আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতিও দেশেই আছে।

মাত্র দুই দশক আগেও বাংলাদেশে হৃদরোগে আক্রান্ত অসচ্ছল রোগীরা প্রায় বিনা চিকিৎসায় প্রাণ হারাতেন। আর যারা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী তারা ছুটতেন বিদেশে। রাজধানীর অসংখ্য সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এখন হৃদরোগের বিশ্বমানের চিকিৎসা হচ্ছে। রয়েছে নামি-দামি কার্ডিয়াক সার্জন ও কার্ডিওলজিস্ট।

সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, মাত্র তিন দশক আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ছোট একটি বিভাগে হৃদরোগের চিকিৎসা শুরু হয়। ওই সময় হৃদরোগ নির্ণয় পরীক্ষা-নিরীক্ষায় শুধুমাত্র স্টেথেস্কোপ, ইসিজি ও এক্সরে মেশিনই ভরসা ছিল।

১৯৮১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের প্রথম ওপেন হার্ট অপারেশন সম্পন্ন হয়। অধ্যাপক নবী আলম খানের নেতৃত্বে ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে দেশে প্রথম ওপেন হার্ট সার্জারি হয়। ওই সফল অস্ত্রোপচারে অংশ নেওয়া চিকিৎসক দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন অধ্যাপক এস আর খান।

হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও কার্ডিয়াক সার্জনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হৃদ্রোগ চিকিৎসায় বাংলাদেশ প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। এ দেশে বেশ কয়েকটি হাসপাতালে আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা হচ্ছে। একেকটি হাসপাতালে প্রতিদিন ৫ থেকে ৬টি বাইপাস সার্জারি হচ্ছে। এসব অপারেশনে দুর্ঘটনা নেই বললেই চলে। অত্যন্ত জটিল এই অপারেশন করে দেশীয় চিকিৎসকরা তাক লাগিয়ে দিচ্ছে বিশ্বকে। এর ফলে হৃদরোগ নিয়ে মানুষের মধ্যে নেই আগের মতো কোনো আতঙ্ক।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকারি-বেসরকারি ২২টি হাসপাতালে বর্তমানে ওপেন হার্ট সার্জারি হয়। এসব হাসপাতালে প্রতিবছর ১০ থেকে ১২ হাজার বাইপাস সার্জারি হয়। ১৫ থেকে ১৬ হাজার এনজিওপ্লাস্টি হয়। ৫০ হাজারের বেশি এনজিওগ্রাম হয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০২০ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে দেশে মারা গেছেন ১ লাখ ৮০ হাজার ৪০৮ জন। আর বিশ্বমানের চিকিৎসার কারণে অন্তত কয়েক লাখ মানুষ নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছেন বলে দাবি হৃদরোগ চিকিৎসকদের।

এ প্রসঙ্গে বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বাসস’কে বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে হার্টের চিকিৎসা আন্তর্জাতিক মানের। এখন কোনো রোগীকে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতে হয় না। হার্টের সকল রোগ নির্ণয়ের জন্য যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন তা দেশেই করা যায়। এছাড়া হার্টেও স্টেন্টিং ও সার্জারিসহ সব চিকিৎসা এখন আমাদের দেশীয় হাসপাতালে হচ্ছে।

বেসরকারি ল্যাবএইড হাসপাতালের চিফ কার্ডিয়াক সার্জন ডা. লুতফর রহমান বাসস’কে বলেন, বাইপাস সার্জারি, স্টেন্টিং এখন শতভাগ সাফল্যের সঙ্গে বাংলাদেশে হচ্ছে। আমরা হাসতে-খেলতে হার্টের জটিল কেসগুলো সামাল দিচ্ছি। হার্টের কোনো সমস্যাই আমরা বড় ইস্যু মনে করি না। আমরা প্রতিদিন ৩ থেকে ৪টি, মাসে অন্তত ৮০ থেকে ১০০টি বাইপাস সার্জারি অনায়াসে শতভাগ সাফল্যের সঙ্গে করছি। সার্জারি নয়, তবে অত্যন্ত বিপজ্জনক কেসগুলোও আমরা সামলাচ্ছি। যাদের হার্টের পাম্পিং ২০-৩০, হার্ট দুর্বল সেগুলোকে আমরা বেলুন সাপোর্ট দিয়ে অপারেশন করছি। যাদের হার্ট অ্যাটাক হয়ে হার্টের পর্দা ফেটে গেছে বা হার্টের ওয়াল পাতলা হয়ে গেছে, সেগুলোকে সার্জিক্যাাল রিকনস্ট্রাকশন করছি।

তিনি বলেন, ভারত, সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকদের থেকেও আমাদের দেশে চিকিৎসকরা রয়েছেন দক্ষ। আমরা আমাদের এই অর্জনকে ধরে রাখতে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছি। এক্ষেত্রে আমাদের ডাক্তার যেমন দক্ষ, তেমনি নার্স-এনেস্থেটিস্টরাও দক্ষ। আমরা সবার সমন্বয়ে কাজ করছি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ তথ্য মতে, বিশ্বে প্রতিবছর হৃদরোগজনিত কারণে অন্তত ১ কোটি ৭৯ লাখ লোক মারা যান। অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, প্রতিবছর বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগে ১ লাখ ১২ হাজারের বেশি মানুষ মারা যান। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪০ হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে হৃদরোগজনিত কারণে। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর ৬৭ ভাগই হচ্ছে অসংক্রামক রোগে। এর মধ্যে ৩৬ দশমিক ১ শতাংশই হৃদরোগী।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এনসিডি কান্ট্রি প্রোফাইল ২০১৮ অনুসারে, বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর ৩০ শতাংশের পেছনে দায়ী হৃদরোগ। সংখ্যার হিসেবে যা প্রায় পৌনে ২ লাখ।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রকাশিত ২০১৭-এর হেলথ বুলেটিনের তথ্য মতে, ২০১৬ সালে শুধুমাত্র জাতীয় হৃদরোগ ইনষ্টিটিউট ও হাসপাতালের বর্হিবিভাগে দুই লাখ ২৬ হাজার ১৩৮ জন রোগী সেবা গ্রহণ করে। ওই বছর একই হাসপাতালে ৬৪ হাজার ৯০৬ জন ভর্তি হয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করেন। ওই বছর হৃদরোগ হাসপাতালে ওপেন হার্ট সার্জারি হয় ৯৯৫ জনের এবং ভাসকুলার সার্জারি হয় আরও এক হাজার ৮২৪ জনের। বিশ্বের অন্যান্য দেশের থেকে আমাদেও দেশের মানুষের ১০ বছর আগেই হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকে। এখন ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সী, এমনকি ২৫-৩০ বছর বয়সীরাও হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হচ্ছে।

এদিকে গত ২ মার্চ বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো মেকানিক্যাল হার্ট ইমপ্ল্যান্ট বা কৃত্রিম হৃৎপিন্ড প্রতিস্থাপন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে হৃদরোগ চিকিৎসায় নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। হার্টের রিং পরানো, বাইপাস সার্জারি, পেস মেকার স্থাপনসহ হৃদযন্ত্রের প্রায় সব চিকিৎসা দেশে আগে থেকেই করা গেলেও বাকি ছিল কৃত্রিম হৃদপিন্ড প্রতিস্থাপন। এবার সেটিও করে দেখালেন বাংলাদেশি চিকিৎসকরা।

রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালের প্রধান কার্ডিয়াক সার্জন ও কার্ডিয়াক সেন্টারের পরিচালক ডা. জাহাঙ্গীর কবির ৪২ বছর বয়সী এক নারীর দেহে এই যান্ত্রিক হৃৎপিন্ড বা ev (Left Ventricular Assist Device-LVAD) এল্ভ্যাড প্রতিস্থাপন করেন।

তিনি বলেন, মানুষের মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ হার্ট ফেইলিওর। এ ধরনের মৃত্যু রোধে দেশে হৃদপিন্ড প্রতিস্থাপন হবে, এটি আমাদের স্বপ্ন ছিল। এ জন্য গত ১৪ থেকে ১৫ বছর ধরে আমরা চেষ্টা করে গেছি। এমনও হয়েছে, হৃদপিন্ড প্রতিস্থাপনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন, কিন্তু নির্ধারিত দিন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এ জন্য সফল হওয়া যাচ্ছিল না। ৪২ বছর বয়সী এক নারী রোগীর কৃত্রিম হৃদপিন্ড প্রতিস্থানের মধ্য দিয়ে সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে হৃদরোগ চিকিৎসায় নতুন যুগে প্রবেশ করলো বাংলাদেশ।

ইউনাইটেড হাসপাতাল সূত্র জানায়, বাংলাদেশে হার্ট সার্জারির প্রথম সারির এই চিকিৎসক দল হাসপাতালের শুরু থেকে প্রায় ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষের হার্টের সফল অস্ত্রোপচার করেছেন। খবর-বাসস

আজকের বাজার/আখনূর রহমান