রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের বিচারিক আদালতে (আইসিজে) করা মামলার বিচার শুরু হয়েছে আজ। দেশের হয়ে আইনি লড়াই চালাতে আদালতে উপস্থিত আছেন মিয়ানমারের ডি ফ্যাক্টো নেত্রী অং সান সু চি।
মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় বিকাল তিনটায় নেদারল্যান্ডসের হেগে আন্তর্জাতিক আদালতে গাম্বিয়ার তথ্য উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে তিনদিনের শুনানি শুরু হয়েছে।
শুনানির প্রথম দিনে রাখাইনে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর চালানো বর্বরতার তথ্য-উপাত্ত ও দেশটির স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চির ভূমিকা আদালতে তুলে ধরেন যুক্তরাষ্ট্রের আইনজীবী তাফাদজ পাসিপান্দো।
তিনি জানান, রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণের কথা অস্বীকার করতে সুচি বলেছিলেন, ‘সেনাবাহিনী এবং বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর কেউ নোংরা বাঙালি মেয়েকে ছোঁবে না। ওরা আকর্ষণীয় নয়। ফেসবুকে ‘ফেক রেপ’ নামে যে পেজ খোলা হয়েছে সেটির নিয়ন্ত্রণও হচ্ছে স্টেট কাউন্সিলরের দপ্তর থেকে।’
মার্কিন আইনজীবী আদালতের কাছে আরাকানে এখনো যে ৬ লাখ রোহিঙ্গা আছেন, তাঁদের দুর্ভোগ ও ঝুঁকির কথা তুলে ধরেন। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের কাঁটাতারের বেষ্টনীর মধ্যে শিবিরে আটক রাখা, চলাচলের স্বাধীনতা খর্ব করা ও অন্যান্য বিধি-নিষেধের কথা যা জাতিসংঘ তদন্তে উঠে এসেছে সেগুলোর বিবরণ দেন তিনি।
আইনজীবী তাফাদজ পাসিপান্দো বলেন, রোহিঙ্গাদের চাষাবাদের জমি কেড়ে নেওয়া হয়েছে, খাদ্য সরবরাহ কমানো হয়েছে, তাদের পালিত পশু কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলে জাতিসংঘ তদন্তে যে তথ্য উঠে এসেছে তার উদ্দেশ্য হচ্ছে, তাদের অভুক্ত রাখা। এগুলো গণহত্যার উদ্দেশ্য হিসাবে সনদের লঙ্ঘন। আরও গণহত্যার অপরাধ যাতে না ঘটে, সে জন্য ব্যবস্থা নিতে পারে এই আদালত। বিভিন্ন প্রমাণ তুলে ধরে তিনি বলেন, এগুলোতে গণহত্যার উদ্দেশ্যের প্রতিফলন ঘটেছে। এরপর তিনি তাঁর বক্তব্য শেষ করেন।
আদালতে ১৫ জন বিচারপতির সঙ্গে যোগ দিয়েছেন দুইজন অ্যাডহক বিচারপতি। ওই দুজন গাম্বিয়া ও মিয়ানমারের মনোনীত। আদালতের সিদ্ধান্ত হবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে। আদালতে অং সান সু চি মিয়ানমারের পক্ষে হাজির হয়েছেন। গাম্বিয়ার পক্ষে আছেন দেশটির আইনমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদু। নিয়মানুয়ায়ী শুরুতেই দুই অ্যাডহক বিচারপতি গাম্বিয়ার নাভি পিল্লাই এবং মিয়ানমারের প্রফেসর ক্লাউস ক্রেস শপথ নিয়েছেন।
শুরুতে গাম্বিয়া যে অন্তর্বতী পদক্ষেপের নির্দেশনা চেয়েছে তা পড়ে শোনান আদালতের রেজিস্ট্রার গটিয়ে। গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রী তামবাদু তাঁর বক্তব্য শুরুতে তাঁর আবেদনের পক্ষে কারা কি বিষয়ে বলবেন তা তুলে ধরেন।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা চালিয়ে মিয়ানমার বৈশ্বিক সনদ লঙ্ঘন করেছে কি না, তার বিচারই আইসিজের এই শুনানির উদ্দেশ্য। একই শহরের ১০ কিলোমিটারের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি), যেখানে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এর আগে উত্থাপিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এখনো তদন্তাধীন।
গাম্বিয়াকে আইনি সহায়তা না দিলেও সার্বিকভাবে সহযোগিতা করছে বাংলাদেশ। গাম্বিয়ার দাবিকে আরও জোরালো করতে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কানাডা ও নেদারল্যান্ডস। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় নিজস্ব আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছে মিয়ানমার ও গাম্বিয়া।
২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত সামরিক অভিযান শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। সামরিক বাহিনীর জ্বালাও-পোড়াও, খুন, ধর্ষণের মুখে ৭ লাখ ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। জাতিসংঘ মিয়ানমার সামরিক বাহিনী এ অভিযান গণহত্যার অভিপ্রায়ে পরিচালনা করেছে বলে মন্তব্য করেছে।
গত নভেম্বরে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের ১৯৪৮ সালের গণহত্যা কনভেনশন লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে হেগের আদালতে মামলা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক এই আদালতে গণহত্যার দায়ে তৃতীয় মামলা এটি।
আজকের বাজার/এমএইচ